দরকষাকষিতে সরগরম হাট
শিপন হাবীব ও হুমায়ুন কবির
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কুরবানির পশুর হাট ধীরে ধীরে জমে উঠছে। রাজধানীর ২০টি হাটে রোববারও ট্রাকে ট্রাকে ঢুকেছে গরু-মহিষ, ছাগল। ক্রেতা সমাগম থাকলেও সেভাবে বিক্রি এখনো শুরু হয়নি। দর-দাম যাচাই করেই সময় পার করছেন ক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভাষ্য, এবার সব হাটেই পশুর দাম কিছুটা বেশি। কিছু ক্ষেত্রে গত বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি দাম চাওয়া হচ্ছে। দাম একটু কমাতে চলছে দরকষাকষি পর্ব। ইজারাদাররা বলছেন, ১-২ দিনের মধ্যে হাটগুলো জমে উঠবে। অনেক স্থানে ব্যস্ততম সড়কেই গরুর হাট দেখা গেছে। এ কারণে সড়কে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে ছাগল বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। রোববার ঢাকার বিভিন্ন হাটে ও পাড়া-মহল্লায় সরেজমিন এমন চিত্রের দেখা মিলেছে।
ব্যাপারীরা শুরু থেকেই বেশি দাম চাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন ক্রেতারা। বিক্রেতাদের ভাষ্য, বেশি দামে গরু কিনে কম দামে বিক্রি করলে আমাদের লোকসান হবে। তারা বলেন, এবার মাঝারি সাইজ অর্থাৎ এক থেকে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। তারা ঘুরেফিরে এ ধরনের গরুর কাছেই ঘেঁষছেন। কিন্তু দাম বলছেন কম, কেউ কেউ এক লাখ টাকার কম দাম বলে চলে যাচ্ছেন। ফলে সেভাবে বিক্রি হচ্ছে না। তবে বাজেট আর পছন্দ মিলে গেলে কেউ কেউ পশু কিনেও ফেলছেন। অনেক ক্রেতা বলছেন, যেহেতু হাতে সময় আছে, অবস্থা দেখে ও বুঝে আরও পরে পশু কিনবেন।
বিক্রেতারা বলছেন, ক্রেতারা এখনো পশু কেনা শুরু না করায় বাজারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাচ্ছে না। ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে বেচাকেনা জমে উঠবে। বিভিন্ন হাটে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই কুরবানির পশু আসছে। ক্রেতার আগ্রহ বেশি থাকায় মাঝারি ধরনের গরুর সংখ্যাই বেশি। বড় গরুও আছে অনেক। অস্থায়ীভাবে পশু খাদ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। হাট ঘিরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাহারা আছে। এছাড়া ইজারাদারদের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি মাইকে অপরিচিত লোকের দেওয়া কিছু না খাওয়ার ঘোষণা দিতে শোনা যাচ্ছে।
রাজধানীর শাহজাহানপুর হাটে রোববার দুপুরেও ট্রাকে ট্রাকে গরু ঢুকেছে। সিরাজগঞ্জের ব্যাপারী হারুন মিয়া দুটি ট্রাকে ২৪টি গরু এনেছেন। ২০ বছর ধরে গরু বিক্রি করছেন জানিয়ে বলেন, এবার গরুর দাম বেশি। কেনা হয়েছে বেশি দামে। খাবারের দাম ও ট্রাক ভাড়া অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি। শ্রমিকের মজুরি বেশি। একটি গরু হাট পর্যন্ত পৌঁছাতে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বাড়তি খরচ হয়। হাটে আরও ৩-৪ দিন থাকতে হলে খরচ বাড়ে। মিলন খান নামের এক ক্রেতা তার দুই সন্তান নিয়ে গরু দেখতে এসেছেন। জানালেন, ২ বছর আগে যে গরু ৫০ হাজার টাকার মধ্যে কিনেছেন এবার তা ৮০ হাজার টাকা চাচ্ছে।
জয়পুর হাট থেকে আফতাবনগর হাটে ১৮টি গরু এনেছেন আব্দুর রহিম। তিনি বললেন, রোববার ভোরে হাটে এসেছেন। সঙ্গে আছেন ৬ জন শ্রমিক। গত বছরের চেয়ে ট্রাক ভাড়া বেশি। দুটি ট্রাকের ভাড়া দিতে হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা। বড় ৩টি গরুর প্রতিটি ১ লাখ ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকায় বিক্রি করবেন বলে জানান। বাকিগুলো ১ লাখ ২০ থেকে দেড় লাখ টাকা দাম পেলেই ছেড়ে দেবেন। ক্রেতারা দরদাম করে কম দামে কিনতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার দাম বেশি। প্রতি মন গরু ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা হিসাবে দাম চাওয়া হচ্ছে। টাঙ্গাইল থেকে ৪টি বড় গরু নিয়ে এসেছেন আলম মিয়া। তার ভাষ্য, ২ দিন আগে এসেছেন। প্রতিটি গরু ২ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করবেন। দেড় লাখ, ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। ২ লাখ ১০ থেকে ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিক্রি না করতে পারলে পুঁজি উঠানোই সম্ভব হবে না বলে জানান।
সায়েদাবাদ হাটে আনুমানিক ৪ মন ওজনের একটি গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। বিক্রেতা সুজনের ভাষ্য, তার বাবাসহ তিনি শরীয়তপুর থেকে ৩টি মাঝারির চেয়ে একটু বড় সাইজের গরু নিয়ে এসেছেন। গ্রামের বাড়িতে গরু তিনটির দাম যা উঠেছিল, তাতে বিক্রি করলে পুঁজিই উঠত না। হাটে আনার পর দাম আরও কম বলছে। আশা করছি, বাজার পুরোদমে জমলে কাক্সিক্ষত দামে বিক্রি করতে পারব। স্থানীয় ব্যবসায়ী গাজী জালাল উদ্দিন জানান, প্রতি বছর তিনটি গরু কিনেন। এবার দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে। কুরবানির পশু কেনার জন্য শেষ সময় পর্যন্ত দেখবেন। মন অনুযায়ী বিক্রি করলেও ২৮ থেকে ৩২ হাজার টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে যে দাম চাওয়া হচ্ছে সেই হিসাবে প্রতি মন মাংস পড়বে ৪০ হাজারের বেশি।
রাজধানীর প্রধান ও স্থায়ী ঐতিহাসিক গাবতলী পশুর হাটে বড় গরুর পাশাপাশি বড় আকারের মহিষও উঠেছে। মিরপুর থেকে আসা ক্রেতা জহিরুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলাম। গত সপ্তাহে দেশে এসেছি। বাজারে গরু-মহিষের দাম চড়া। ব্যাপারীরা বলছেন, খামারি বা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে গরু-মহিষ কেনা হয়েছে। গরুর খাবারের দামও বেশি। ঢাকার বাজারে মাংসের কেজিই বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৮০০ টাকা। তাছাড়া গ্রাম থেকে গরু সংগ্রহ করে হাট পর্যন্ত পৌঁছাতে পদে পদেই টাকা গুনতে হচ্ছে। এসব কারণেও গরুর দাম বেশি পড়ছে। গাবতলী গরুর হাটের ম্যানেজার হাসেম বলেন, গাবতলী হাটে গরু-মহিষ, ছাগলে ভরে গেছে। ৮ হাজারের উপরে পশু রয়েছে। রোববার সকালে বৃষ্টি হওয়ায় বেচাকেনা একটু মন্দা। রাতে ভালো হবে।
কমলাপুর ও মেরাদিয়া পশুর হাটও জমে উঠেছে। বৃহস্পতিবার থেকেই অস্থায়ী এ দুটি হাটে পশুর ট্রাক আসছে। এ দুটিতে খামারের গরু বেশি এসেছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। পাবনা থেকে কমলাপুর হাটে ২২টি গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ৭ জন মিলে গরুগুলো শুক্রবার নিয়ে এসেছেন। ২টি গরু বিক্রি হয়েছে। রোববারও দরদাম হচ্ছে। দাম শুনে অনেকেই চলে যাচ্ছেন। আশা করছি সোম-মঙ্গলবার থেকে পুরোদমে বিক্রি শুরু হবে।
মোহাম্মদপুর বসিলা ও যাত্রাবাড়ী পশুর হাটে প্রচুর গরু উঠেছে। তবে দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছেন। যাত্রাবাড়ী হাটে একটি মাঝারি আকারের গরু কিনতে এসেছেন চাউল ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় ৪০-৬০ হাজার টাকা বেশি দাম চাচ্ছেন বিক্রেতা। ঘুরে ঘুরে দেখছি, কী করা যায়। এদিকে শনিরআখড়া পশুর হাট জমে উঠেনি। বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, পানি, টয়লেট,পশু চিকিৎসক সংকট এ হাটে। পর্যাপ্ত পরিমাণে বৈদ্যুতিক বাতি নেই। যারা আসছেন তারা বলছেন, চড়া দাম।
ডেমরার সারুলিয়া ও আমুলিয়া মডেল টাউন পশুর হাটে অনেক গরু উঠেছে। ক্রেতার সমাগম থাকলেও উল্লেখযোগ্য বিক্রি নেই বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। সারুলিয়া স্থায়ী পশুর হাটের পরিচালক শামীম আহম্মেদ বলেছেন, ক্রেতারা দাম বেশি চাচ্ছেন বলে বিক্রি একবারেই নেই। দুদিন ধরে ৬-৭টি করে গরু ও ছাগল বিক্রি হচ্ছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে বিক্রি বাড়বে বলে আশা করছি।
পশু বিক্রেতা ও ইজারাদাররা বলছেন, সোম-মঙ্গলবার থেকেই দেদার পশু বিক্রি শুরু হবে। তবে দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মধ্যে শঙ্কা কাজ করছে। ক্রেতারা বলছেন, বাজারে সব কিছুর দাম। তার উপর পশুর দামও বেশি। আশা অনুযায়ী পশু কেনা হবে না অনেকের। আবার বিক্রেতারা বলছেন, হাট থেকে ফেরত নেওয়ার জন্য পশুগুলো আনা হয়নি। লাভের আশায় তারা এগুলো বাজারে তুলেছেন। ক্রেতারা যাতে বাজারে এসে দর-দাম যাচাই করেই পশু কেনেন-এমন অনুরোধ জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অবশ্য জানাচ্ছে, এ বছর চাহিদার চেয়েও বেশি পশু কুরবানির জন্য প্রস্তুত আছে। দাম-দর ঠিক থাকবে। গত বছর দেশে পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ২১ লাখ। এর বিপরীতে কুরবানি হয়েছে ৯৯ লাখ। এ বছর চাহিদা ও জোগান দুটোই বেড়েছে। এ বছর কুরবানির জন্য পশু প্রস্তুত আছে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি। কিন্তু সম্ভাব্য চাহিদা হবে প্রায় ১ কোটি। সব মিলিয়ে কুরবানির পশু উদ্বৃত্ত থাকবে ২৫ লাখের মতো।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী যুগান্তরকে জানান, এবার যে দাম বাড়বে বুঝা যাচ্ছে। তবে আমরা তো দাম নির্ধারণ করে দিতে পারি না। আমরা বলতে পারি উৎপাদন খরচ কত সেটা। পশুপালনে খাদ্যের দাম বাড়তি। খামারিদের খরচ বেশি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে খামারি থেকে মধ্যস্বত্বভোগীরা পশু কেনে। তারা আবার তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করেন। আমরা চাই, কোনো অবস্থাতেই যেন অযৌক্তিক দাম রাখা না হয়। যৌক্তিক পর্যায়ে পশু কেনা-বেচা হোক তিনি এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।