মুদ্রানীতির প্রভাবে বাড়ছে সুদহার
বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়বে শিল্প খাত
সব খাতে বাড়বে উৎপাদন খরচ, অসম প্রতিযোগিতায় বেশি বিপদে পড়বে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান * অর্থনৈতিক মন্দায় পণ্য বিক্রি আরও কমবে, কমবে না মূল্যস্ফীতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) খুশি করতে গিয়ে চরম ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দেশের স্বনামধন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের। রোববার ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সরকারের এমন বৈরী আচরণ আরও স্পষ্ট হয়েছে। কেননা ঋণের সুদের হার বাড়ানোকেই মুদ্রানীতির প্রধান হাতিয়ার বানানো হয়েছে। এ কারণে রপ্তানীমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ শিল্প ও ব্যবসা সেক্টরের প্রতিটি ধাপে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কারণ, ডাবল ডিজিটে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শিল্প চালাতে গেলে নির্ঘাত উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। সে তুলনায় পণ্যের দাম যেমন পাওয়া যাবে না, তেমনই বিক্রিও কমে যাবে। এজন্য মুদ্রানীতির এমন বিরূপ অবস্থানকে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা মোটেই ভালোভাবে নিতে পারছেন না। তারা বলছেন, এটা সে ফ আত্মঘাতী। এতে বেশি বিপাকে পড়বেন শিল্প খাতের ভালো ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতিকে মন্দার কবল থেকে উদ্ধার করতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উৎপাদন খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানো।
কিন্তু মুদ্রানীতিতে সেটি করা হয়নি। উলটো বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরকারকে বেশি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাত। কারণ, কর্মসংস্থান তৈরি না হলে দেশে উৎপাদন বাড়বে না। মানুষের আয় বাড়বে না। ফলে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়বে।
সূত্র জানায়, করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে সাড়ে তিন বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এবার এর পক্ষে সহায়ক নীতি নেওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এবারও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করায় বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ সবকিছু বাধাগ্রস্ত হবে। এসব খাতকে উত্তম সহযোগিতা করার কোনো নীতি রাখা হয়নি। উলটো আরও বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। অথচ দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে।
মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে। সেখানে উচিত ছিল-যারা সত্যিকারের ভালো ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা, যাদের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারের কোনো অভিযোগ নেই; তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটি না করায় ভালো ব্যবসায়ীরা আরও হতাশ হবেন এবং ভবিষ্যতে তারা শিল্প খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করার সাহস দেখাবেন না।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতি ব্যবহার করে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যাবে না। এতে সুদের হার ও ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসতে পারে; কিন্তু মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানা সম্ভব হবে না। বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম বেশি মাত্রায় টানা হয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সুদের হার ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে শিল্পের খরচ বেড়ে যাবে। ফলে বেসরকারি খাত আরও প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে।
প্রসঙ্গত, রোববার ঘোষিত মুদ্রানীতির প্রভাবে ১ জুলাই থেকে সব ধরনের ঋণের সুদের হার বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে ডলারের দাম। এমনিতেই সাড়ে তিন বছর চলা অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসাবাণিজ্যের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বর্ধিত সুদের হার। এরকম ত্রিমুখী সংকটে দেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচক আরও নিম্নমুখী হবে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা, উলটো বেকারত্ব আরও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তারা বলেছেন, দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইতোমধ্যে বড় ধরনের সংকটে পড়ে অনেকে প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নিয়েছেন। বেকার হয়ে গেছেন বহু শ্রমিক-কর্মচারী। প্রথম সারির বড় শিল্পগুলো অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখনো লড়াই করে যাচ্ছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক মন্দার কারণে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি দেশে ডলারের দাম বেড়েছে লাগামহীন গতিতে। এর ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। অথচ যেভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, সেভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো যায়নি। আবার দেশের বাজারে পণ্যের দাম কিছুটা বাড়ানোর কারণে বিক্রি কমে গেছে। কারণ, মন্দায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। রপ্তানিমুখী শিল্পের ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেই হারে পণ্যের দাম বাড়েনি। ফলে রপ্তানিকারকরা ক্রেতা ধরে রাখার লড়াইয়ে ব্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ-এর শর্তের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঋণের সুদের হার ও ডলারের দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
ফলে এখন শিল্প খাতের জন্য যেসব ঋণ ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর সুদ বেড়ে সোয়া ১০ শতাংশ হবে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্পের জন্য যেসব ঋণ ৯ শতাংশ সুদে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো নিতে হবে সোয়া ১১ শতাংশে। এছাড়া ভোক্তারা ঋণ নিয়ে যেসব শিল্পপণ্য ক্রয় করেন, সেসব ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হবে সোয়া ১১ শতাংশ। সব খাতেই ঋণের সুদহার বাড়ার কারণে খরচও বেড়ে যাবে।
এদিকে ডলার সংকটের মধ্যে এর দাম বেড়ে আমদানিতে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায় উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই দামে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ১১২ থেকে ১১৪ টাকা বা এর বেশি দামেও ডলার বিক্রি হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। ফলে চাহিদা বেশি থাকলে এর দামও বেড়ে যাবে।
তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে আমদানির জন্য ডলার বিক্রি করবে আন্তঃব্যাংকের দামে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করে ১০৬ টাকা করে। আন্তঃব্যাংকে এর দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায় উঠেছে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ১০৯ টাকা করে ডলার বিক্রি করবে। এতে প্রতি ডলারের দাম বাড়বে ৩ টাকা। আন্তঃব্যাংকে ডলারের চাহিদা থাকলে দামও বাড়বে। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোয় ডলারের দাম বাড়বে। এতে আমদানি খরচ বেড়ে গিয়ে শিল্প খাত আরও সংকটের মুখে পড়বে।
ডলারের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের রয়েছে নিরন্তর অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভপাতি জসিম উদ্দিন বলেছেন, ব্যাংকাররা ডলারের দাম নিচ্ছে লুটের মালের মতো। ১১৪ থেকে ১১৫ টাকা দাম নিচ্ছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এর দর সর্বোচ্চ ১০৮ টাকার মধ্যেই থাকবে বলে তারা বাজার জরিপে জানতে পেরেছে। কিন্তু বাজারে এখন আমদানির ডলার অফিশিয়ালি ১০৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ১০৮ টাকায় খুব কম ব্যাংকেই ডলার মিলছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা যাচ্ছে না। এখন যাদের ডলার আছে, তারাই শুধু এলসি খুলতে পারে। বিশেষ করে রপ্তানিকারক ছাড়া অন্যরা এলসি খুলতে পারছেন না বললেই চলে। ফলে আমদানিনির্ভর ব্যবসায় ধস নেমেছে।
রেমিট্যান্স বাবদ যেসব ডলার আসছে, সেগুলোর বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানিতে। এসব ডলার বাণিজ্যিক আমদানিকারকরা পাচ্ছেন না। ফলে আমদানিনির্ভর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন হাত গুটিয়ে বসে আছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দীর্ঘ সময় ডলার সংকটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করায় আমদানিনির্ভর শিল্পগুলো সংকটে পড়েছে। এতে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখন সরবরাহ সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করেছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো সংকটকে দীর্ঘ সময় চলতে দেওয়া উচিত নয়। ডলার সংকট চলছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। এ সংকট আরও চলতে থাকলে অর্থনীতিতে চাপের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব শিল্পের পাশাপাশি সাধারণ ভোক্তাদের ওপর পড়বে।
মুদ্রানীতিতে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৩ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। বেসরকারি খাতের চেয়ে সরকারি খাতের ঋণের জোগান বেশি দেওয়ার কারণে সুদের হার যেমন আরও বাড়তে পারে, তেমনই বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কমে যাবে। এতে ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বাড়তে পারে, যা বেসরকারি খাতকে আরও আক্রান্ত করবে। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ব্যাংক থেকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণের জোগান দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বেসরকারি খাতের জন্য সেটি করে না। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের জোগান কমে যাবে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। বর্তমান রিজার্ভ ২ হাজার ৯৮৭ কোটি ডলার। নিট হিসাবে তা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মতো। রিজার্ভ কম হলে এলসির ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংকগুলোয় বাড়তি কমিশন দিতে হবে। তখন আমদানি খরচ আরও বাড়বে। এতে দেশের রপ্তানি খাতসহ অন্যান্য শিল্প খাত আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণের সুদের হার বাড়ার কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। সারা বিশ্ব এখন কম দামে বেশি পণ্য রপ্তানির প্রতিযোগিতা করছে। সেখানে আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হবে।
সূত্র জানায়, আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম গড়ে ১৫ শতাংশ এবং গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দামও। ফলে উৎপাদন খরচ শুধু বেড়েই যাচ্ছে। উপরন্তু বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস ও বিদ্যুৎ মিলছে না। ফলে কারখানা সব সময় চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে একদিকে খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে উৎপাদন কমছে। কারণ কারখানা বন্ধ থাকলেও শ্রমিক-কর্মীদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে হচ্ছে।
করোনার আগে থেকে শিল্প খাতে ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়। করোনার সময় ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে গত বছরও তা বহাল ছিল। চলতি বছর থেকে প্রণোদনাগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে এখন ঋণের কিস্তি শোধ করতে হচ্ছে। এদিকে বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনীতিতে মন্দায় উদ্যোক্তাদের কাছে নগদ অর্থের প্রবাহ কমে গেছে। ফলে তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও কমেছে। এতে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তা খেলাপি হবে। আর খেলাপি হলে সব ব্যবসা-বাণিজ্য আটকে যাবে। এতে শিল্প খাতে আরও বিপর্যয় আসতে পারে।