সরকারি অফিস ছুটি : ঈদযাত্রা শুরু
তীব্র গরমেও নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ১০ কিমি. যানজট * বিকালের পর থেকে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে ভিড় * ছয়টি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের পর ছেড়েছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
সরকারি অফিস-আদালতে আজ থেকে শুরু হয়েছে ঈদের ছুটি। মঙ্গলবার ছিল শেষ কর্মদিবস। অফিস ছুটি হতে না হতেই বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা করতে দেখা গেছে অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকেও। রাজধানীর বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনগুলোয় দুপুর পর্যন্ত যাত্রীচাপ ছিল না বললেই চলে। তবে বিকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এসব টার্মিনালে যাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। এদিন সড়ক-মহাসড়কে মঙ্গলবার তেমন একটা যানজট ছিল না।
তবে ঢাকার ভেতরেই যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট ছিল। তীব্র গরম ও যানজটে যেন হাঁসফাঁস অবস্থা তাদের। এমন অবস্থার মধ্যেও নাড়ির টানে গ্রামে ছুটে যাচ্ছেন নগরবাসী।
রাজধানীর কমলাপুর থেকে বেশির ভাগ ট্রেন সময়মতো ছেড়ে গেছে। তবে ছয়টি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। অপরদিকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ৫৫টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। আরও ২৫টি লঞ্চ ছাড়ার অপেক্ষমাণ অবস্থায় ছিল। সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, সামনে এসএসসি পরীক্ষা এবং তীব্র গরমসহ নানা কারণে এবার ঈদযাত্রায় যাত্রী অন্যান্য বছরের চেয়ে কম হবে বলে মনে হচ্ছে। এছাড়া সরকারি ছুটি দীর্ঘ হওয়ায় একই সঙ্গে যাত্রীচাপ পড়ার আশঙ্কা কম। তবে বিষয়টি অনেক গার্মেন্ট ছুটির ওপর নির্ভর করছে। একই দিন অনেক গার্মেন্ট ছুটি হলে পরিবহণের ওপর যাত্রীচাপ বেড়ে যাবে। তখন শৃঙ্খলা ধরে রাখাও কঠিন হবে।
গাবতলী হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার মাস্টার রুবেল জানান, মঙ্গলবার সকাল থেকেই গাবতলীতে যাত্রী ছিল না বললেই চলে। বিকাল থেকে যাত্রী আসতে শুরু করে। সেটাও খুব বেশি নয়। প্রতি বৃহস্পতিবার যাত্রীর চাপ যেরকম, মঙ্গলবার সেই অবস্থা ছিল। তিনি বলেন, যাত্রীর যে অবস্থা, তাতে ঈদযাত্রা বলা যাবে না। ঈদের কোনো চাপ নেই। আগে ঈদের ছুটির শেষ কর্মদিবসে গাবতলীতে লোকেলোকারণ্য থাকত। তখন ৪০-৪৫ ট্রিপ বাস ছেড়ে যেত। সেখানে আজ বিকাল পর্যন্ত ১২টি বাস ছেড়েছে।
তবে মঙ্গলবার বিকাল থেকে রাজধানীর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও আশপাশ এলাকায় বাড়িমুখী যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ওই এলাকায় বাস, ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের চাপও ছিল বেশি। এতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সাইনবোর্ড এবং যাত্রাবাড়ী-দোলাইরপাড়-পোস্তগোলা সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ঢাকা থেকে বের হতেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে যাত্রীদের।
যাত্রাবাড়ী (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, দুপুরের পর থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ও কাউন্টারগুলোয় যাত্রীদের ঢল নামে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে কাজলা পর্যন্ত সড়ক বেহাল। সড়কে ছোটবড় অসংখ্য গর্ত রয়েছে। যানবাহন চলে হেলেঢুলে। এতে সায়েদাবাদ বাসটার্মিনাল থেকে যাত্রাবাড়ী মোড় হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড পর্যন্ত তীব্র যানজটে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পড়তে হয়। এছাড়া যাত্রীদের অভিযোগ, ঈদ সামনে রেখে বিআরটি-এর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছেন কয়েকটি পরিবহণের শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ নাজের আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরুর পর সায়েদাবাদ এলাকায় গাড়ি চলাচল বেড়েছে। সড়কে মানুষ ও যানবাহনের চাপ অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ঈদের আগে ও পরে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা এবং পুনরায় কর্মস্থলে ফেরত আসা মানুষের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে আমরা কাজ করছি। সেজন্য আমাদের অতিরিক্ত ফোর্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহন যাতে সড়কে চলতে না পারে সেজন্যও আমাদের অভিযান চলছে।
এদিকে ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে ট্রেনে অনেকটাই স্বস্তিতে ফিরেছেন।
ট্রেন : ঈদযাত্রায় দ্বিতীয় দিনেও ট্রেনে যাত্রীদের খুব একটা ভিড় চোখে পড়েনি। মঙ্গলবার সকাল থেকে অধিকাংশ ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। ধূমকেতু, নীলফামারী, তিস্তাসহ ৬টি ট্রেন ২০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার যুগান্তরকে বলেন, ৪-৫টি ট্রেন ছাড়া বাকি সব ট্রেন সঠিক সময়ে ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে। বিনা টিকিটে কোনো যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ করতে পারছে না।
ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনেও ভিড় তেমন চোখে পড়ছে না। ২০ ও ২১ এপ্রিল ভিড় বাড়বে। চট্টগ্রাম রুটে দুর্ঘটনার কারণে ১৭ এপ্রিলের ‘সোনার বাংলা’ এক্সপ্রেস ট্রেন ১৯ এপ্রিল চলবে। তিনি জানান, যারা অগ্রিম টিকিট কাটতে পারেননি, তাদের জন্য সীমিতভাবে শুধু যাত্রার দিন ২৫ শতাংশ সিটবিহীন টিকিট দেওয়া হচ্ছে।
লঞ্চ : নৌপথের যাত্রীদের দুর্ভোগ গুলিস্তান-সদরঘাট : পদ্মা সেতু চালুর পর লঞ্চযাত্রী অনেক কমে গেছে। মঙ্গলবারও যারা নৌপথে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছেন, তাদের দুর্ভোগ ছিল গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যাতায়াত। এ পথে তীব্র যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়েছে যাত্রীদের।
মিরপুর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সদরঘাট আসা সিরাজুল ইসলাম বলেন, সব সময় লঞ্চে পটুয়াখালী গেছি, আজও এলাম। কিন্তু রাস্তায় যে যানজট, তাতে ত্রাহি অবস্থা। তিনি বলেন, গুলিস্তানে সড়কজুড়ে বাস ও টেম্পো এলোপাতাড়ি করে রাস্তায় রেখে যাত্রী তুলছে। পুরো রাস্তার দুই পাশেই মালামাল রেখে ব্যবসাও চলছে। এতে রাস্তা সরু হয়ে যানজট তৈরি হয়। যাত্রীদের ভোগান্তি হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, নৌপথের যাত্রীদের নিরাপত্তায় লিফলেট বিতরণ করেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি প্রতিটি লঞ্চে নিরাপত্তা সরঞ্জাম রাখতে মালিকদের অনুরোধ জানান।
এদিকে মাওয়ার শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি রুটে মঙ্গলবার সকাল থেকে ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার শুরু হয়েছে। সেখানে কলমিলতা ও কুঞ্জলতা দুটি ফেরি চালু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। দীর্ঘদিন পর এ রুটে ফেরি চালু হলেও এদিন দুপুরে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ার কথা জানানো হয়।
মাওয়ায় ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার শুরু : শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, ঈদ সামনে রেখে মাওয়ার শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি রুটে ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার শুরু হয়েছে। কলমিলতা ও কুঞ্জলতা দুটিতে ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার করা হয়। যাত্রীসহ প্রতিটি মোটরসাইকেল থেকে ভাড়া নেওয়া হয় ১৫০ টাকা।
গত বছরের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়। ২৬ জুন সকাল থেকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেতুটি। ওইদিনই রাতে বেপরোয়া মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুতে দুজন নিহত হন। দুর্ঘটনা এড়াতে ২৭ জুন ভোর ৬টা থেকে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সেতু কর্তৃপক্ষ। পদ্মা সেতুর বিকল্প হিসাবে শিমুলিয়া-মাঝিকান্দি রুটে ফেরি চালু হলো। যদিও বৃহস্পতিবার থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে। এ সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার দুপুরে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) পরিচালক (বাণিজ্য) এসএম আশিকুজ্জামান জানান, সকাল ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে ১৬৯টি মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরি কলমিলতা শিমুলিয়া ঘাট থেকে রওয়ানা করে। প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ফেরিটি মাঝিকান্দি ঘাটে পৌঁছায়। সেখান থেকে ৬টি মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরিটি আবারও শিমুলিয়া ঘাটে চলে যায়। সকাল ৯টার দিকে ৮৯টি মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরি কুঞ্জলতাও শরীয়তপুরের মাঝিকান্দি ঘাটে যায়। এভাবে সারা দিন ফেরিতে মোটরসাইকেল পারাপার করা হয়।
চট্টগ্রামে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনেও চট্টগ্রামে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। মঙ্গলবার নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর ছেড়ে গেছে সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস। দেড় ঘণ্টা পর ছেড়ে যায় ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস।
তীব্র গরমে এ দুই ট্রেনের অপেক্ষমাণ যাত্রীদের হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, কুমিল্লায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ার জেরে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় তৃতীয় দিনে গড়িয়েছে। তবে বেশ কিছু ট্রেন যথাসময়ে প্ল্যাটফরম থেকে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। এদিন চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রীদের তেমন কোনো ভিড় দেখা যায়নি।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন সূত্র জানায়, সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট দেরিতে সেটি চট্টগ্রাম স্টেশন ছাড়ে। একইভাবে ময়মনসিংহের উদ্দেশে বিজয় এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৯টায়।
কিন্তু সেটিও ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ে। সকাল ১০টায় যথাসময়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। ১১টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যায় চাঁদপুর স্পেশাল-১। সাড়ে ১২টায় মহানগর এক্সপ্রেস, বিকাল ৩টায় মহানগর গোধূলি, ৩টা ২০ মিনিটে চাঁদপুর স্পেশাল-২, ৩টা ৪০ মিনিটে ময়ময়নসিংহগামী নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস ও ৫ট ২০ মিনিটে ছেড়ে যায় মেঘনা এক্সপ্রেস।
চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার জাফর আলম যুগান্তরকে বলেন, তিনটি ট্রেন ছাড়া সব ট্রেন যথাসময়ে চট্টগ্রাম স্টেশন ত্যাগ করেছে। দুর্ঘটনার পর নতুন বগিতে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে সোনার বাংলা। মূলত যেসব ট্রেন আসছে, সেগুলো ছাড়তে দেরি হচ্ছে। কুমিল্লায় দুর্ঘটনার পর শিডিউলে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।