দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
বিএনপির সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ
নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা, জোটগতভাবে ভোট, আসন ভাগাভাগি, দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা
হাবিবুর রহমান খান
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বহুমুখী চ্যালেঞ্জে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়। সে লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। এবার সফলতার বিকল্প ভাবছে না। তবে কোনো কারণে ব্যর্থ হলে দলটির করণীয় কী হবে, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। এছাড়া যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া, নানা প্রলোভন ও চাপের মধ্যে আন্দোলনে শরিকদের ধরে রাখা কঠিন কাজ বলে মনে করছেন নেতারা। এছাড়া আসন ভাগাভাগি, যোগ্যদের মনোনয়ন দেওয়া, দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখাও বিএনপির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
দলটির নেতারা মনে করেন, ইভিএম না থাকায় ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু ব্যালটে নির্বাচন হওয়ায় ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ সরকার দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। প্রশাসনসহ সর্বত্র তাদের অনুসারীরা সক্রিয়। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার সহায়তায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টা চালাতে পারে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও ভোটকেন্দ্র যাতে দখলে নিতে না পারে, সেই প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়াতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুধু বিএনপি নয়, জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচনসংক্রান্ত অনেক চ্যালেঞ্জই সহজ হয়ে যাবে। আসন ভাগাভাগি, মনোনয়ন কিংবা অন্য বিষয়গুলো নিয়ে জটিলতা হবে না।
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই তারা ভোটে অংশ নেবে। দলটির নেতারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে অনুকূল পরিবেশ ও সমান সুযোগ পাবে না। এতে নির্বাচনি ফলাফল কী হবে, তা সবাই জানে। তাই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া একই কথা। তবে দলের এ অবস্থান শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে নানা আলোচনা। কারণ, বিএনপির একটি অংশ নির্বাচন বয়কটের পক্ষে নয়। সংলাপের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তারা ভোটে যাওয়ার পক্ষে। তাদের মতে, সরকার যদি অতীতের মতো আরেকটি নির্বাচন করে উতরে যায়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে। তবে দলটির বেশির ভাগ নেতাকর্মীই এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে। আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়েই গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন মতভেদ দূর করতে হবে। এমন একটি বার্তা দিতে হবে যাতে কারও মধ্যে কোনো সংশয় সৃষ্টি না হয়।
পরিকল্পিত আন্দোলনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় দলটির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন করছে বিএনপি। কিন্ত এখন পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে অটুট ঐক্য গড়ে ওঠেনি। এ লক্ষ্যে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। বিএনপির কয়েক নেতা যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। আদর্শের চেয়ে লাভের দিকটাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। অনেক দলকে চাপের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়ে জোট থেকে বের করে নেওয়ার চেষ্টা চালাবে। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। তাই আন্দোলনে সফলতা আদায়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখাও চ্যালেঞ্জ।
সমমনা দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপির মধ্যে ঐক্য ধরে রাখাও বিএনপির হাইকমান্ডের সামনে চ্যালেঞ্জ। কারণ, গুঞ্জন রয়েছে-বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে নেওয়ার ব্যাপারে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে দলের কয়েক নেতাকে নিয়ে হাইকমান্ডের সন্দেহ সৃষ্টি হয়। তাদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে। নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন তৎপরতা আরও বাড়তে পারে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখাও দলটির অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
বিএনপির একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, শুধু আন্দোলন নয়, নির্বাচনে অংশ নেওয়া, মনোনয়ন চূড়ান্ত করাও দলটির হাইকমান্ডের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেবে। সরকারবিরোধী দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করা হচ্ছে। আগামী দিনে সরকার গঠন করা হলে এসব দল নিয়ে জাতীয় সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আগামী নির্বাচন কীভাবে করা হবে, তা নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আন্দোলনে থাকা বেশির ভাগ দলই জোটগতভাবে ভোট করার পক্ষে। সেই সিদ্ধান্ত হলে জামায়াতকে নিয়ে কী করবে, তাও সামনে আসবে। জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলে এরপর সামনে আসবে আসন ভাগাভাগির প্রশ্ন। এটাই হবে বিএনপির হাইকমান্ডের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ, আন্দোলনে থাকা বেশির ভাগ দলের তেমন জনভিত্তি নেই। কিন্ত ব্যক্তি হিসাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যে কোনোভাবে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইবেন। আবার জোটের শরিকদের আসন ছেড়ে দিলে বিএনপিতে দেখা দিতে পারে ক্ষোভ, হতাশা। সবমিলিয়ে সুষ্ঠুভাবে আসন ভাগাভাগিতে বেগ পেতে হবে দলটিকে।
জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, সরকার সাধারণ মানুষের দাবির ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সরকার একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাদের স্বার্থকে সমর্থন দেয়। তারা আবার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের সমর্থন দেয়। এভাবে তারা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেছে। এদের কাছ থেকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করাই হচ্ছে বিএনপির মূল চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে দলের হাইকমান্ড ঘোষণা দিয়েছে। তবে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। যেহেতু আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এ সরকারের পতন। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন হলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের শরিকদের মধ্যে বোঝাপড়ায় সময় লাগবে না। এ নিয়ে কোনো সংকটও হবে না।