Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

গন্তব্যহীন উন্নয়নের ধকল

ট্রেনযাত্রীরা দুর্নীতির কাছে বড় অসহায়

প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পদের পরিমাণ-উৎস খোঁজা উচিত। রেলে উন্নয়ন প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় হচ্ছে, যেখানে দুর্নীতি থাকার শঙ্কা সবচেয়ে বেশি-ইফতেখারুজ্জামান-টিআইবি * রেলে দুর্ঘটনা, যাত্রী হয়রানি থেকে শুরু করে অব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না-অধ্যাপক ড. শামসুল হক * আমরা দুর্নীতিবাজ কাউকে ছাড় দিচ্ছি না, আরও কঠোর হচ্ছি-রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রেনযাত্রীরা দুর্নীতির কাছে বড় অসহায়

বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য প্রকল্পের যেন শেষ নেই। শুধু চলমান ৩৯টি প্রকল্পেই বরাদ্দের পরিমাণ পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা। বলা যায় রীতিমতো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে রেল। কিন্তু যাত্রীসেবা সেই তিমিরেই। ফলে আড়ালে পাল্লা দিয়ে মোটা-তাজা হচ্ছে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’।

অভিযোগ রয়েছে-জড়িতদের চিহ্নিত করাসহ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কখনও নেওয়া হয় না। নেই কোনো জবাবদিহিতা। এসব কারণে রেলের শত অনিয়ম-দুর্নীতির কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এ যেন অসহায় আত্মসমর্পণ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়িত্বশীলদের অনেকেই ছুটছেন কালোটাকার পেছনে। যে কারণে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ, স্টেশন সংস্কার ও টিকিট কালোবাজারি ঠেকাতে নজর নেই তাদের।

অথচ সে তুলনায় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি হয়নি বললেই চলে। নামমাত্র কয়েকজনের চাকরি গেছে। এখনো অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ঘুরছেন দুদকের বারান্দায়।

রেলের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিম্নমানের যাত্রীসেবার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, সেবা-নিরাপত্তায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে। দুর্নীতিতে জড়িতদের চিহ্নিত করে নেওয়া হচ্ছে কঠোর ব্যবস্থা।

টিকিট কালোবাজারি বন্ধে ইতোমধ্যে শতভাগ টিকিট অনলাইনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে রেলের আধুনিকায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে অনেক নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্প শেষ হলে রেলে আমূল পরিবর্তন সাধিত হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে ১৪২টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে যাত্রীর তুলনায় এখনো ট্রেনের সংখ্যা অনেক কম। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় যাত্রী সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এছাড়া আগামী ঈদে যাতে যাত্রী দুর্ভোগ না হয় সে বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেব।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, রেলে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনেক ক্ষেত্রেই প্রমাণিত। ফলে যাত্রীসেবা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের কটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে?

রেললাইন স্থাপনে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় কত? এগুলো উন্নত রাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি দেখানো হচ্ছে। তাই প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ঠিকাদার পর্যন্ত সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। তাদের সম্পদের পরিমাণ এবং উৎসও খোঁজা উচিত।

সরেজমিন কমলাপুর : দেশের প্রধানতম স্টেশন ঢাকার কমলাপুরে ঢুকলেই সারা দেশের রেল সেবার পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। এখানে স্টেশন চত্বর ঢাকা পড়েছে ময়লা-আবর্জনায়। প্ল্যাটফরমের নিচে রেললাইনজুড়ে মলমূত্র ও নোংরা পানিতে সারাক্ষণ ঠাসা থাকে। ওদিকে প্ল্যাটফরমে সারাক্ষণ লেগে থাকে ছিন্নমূল মানুষের জটলা। নেশাগ্রস্তদের উৎপাতে নিরাপত্তাহীন পরিবেশ।

যে কোনো মুহূর্তে টানা পার্টি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়ার আশঙ্কা থাকে। স্টেশনে সুপেয় পানির যেমন তীব্র সংকট রয়েছে, তেমনি গণশৌচাগার নিয়ে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। কারণ ৭টি প্ল্যাটফরমের কোথাও নেই শৌচাগার। স্টেশন মাস্টারের কক্ষ লাগোয়া ছোট্ট টয়লেটে একজন ঢুকলে লম্বা লাইন পড়ে যায়। কিছুটা দূরে আরেকটি পাবলিক টয়লেট থাকলেও তা এসি টিকিটের যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে রেল স্টেশনের সংখ্যা ৪৪৮টি। তবে প্রধান স্টেশনের অবস্থা এমন হলে বাকিগুলোর অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়। কমলাপুর স্টেশনে চট্টগ্রামগামী কামরুল ইসলাম নামের জনৈক যাত্রী সোমবার যুগান্তরকে বললেন, ‘স্টেশন ছাড়াও প্রায় প্রতিটি ট্রেনের শৌচাগার ব্যবহার অনুপযোগী।

মাদক সেবনের উপকরণ কিংবা মলমূত্রে ভরা থাকে টয়লেট। এছাড়া তেল চিটচিটে অপরিচ্ছন্ন সিটে বসে যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়। মন না চাইলেও অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে এ ধরনের নোংরা সিটে বসেন।

কখন ট্রেন আসবে? এটি আরও একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে ঘোষণার ব্যবস্থা নেই খোদ কমলাপুর স্টেশনে। ছাড়ার ঘোষণা থাকলেও কখন এসে পৌঁছবে তা বলা হয় না।

অনেক সময় একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরফলে যাত্রী হুড়োহুড়িতে পড়ে অনেকে আহত হন। এ সময় নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের নিয়ে ট্রেনে ওঠা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

নামেই স্টেশন : প্রায় সাড়ে চারশ স্টেশনের মধ্যে মাত্র ৭টিতে প্ল্যাটফরমজুড়ে ট্রেন দাঁড়াতে পারে। বাকিগুলোয় ট্রেনের ৪ ভাগের ৩ ভাগই প্ল্যাটফরমের বাহিরে থাকে। ফলে রোদ-বৃষ্টি এবং রাতে অন্ধকারে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্ল্যাটফরমের বাহিরে নামা যাত্রীদের অনেক সময় ঝোপ-জঙ্গলেও নামতে হয়।

বিষধর সাপেরও ভয় থাকে। আবার ৯০ শতাংশ স্টেশন প্ল্যাটফরম থেকে ট্রেনের উচ্চতা বেশি। উচ্চতা বেশি হওয়ায় ট্রেনে উঠতে গিয়ে হরহামেশা দুর্ঘটনার কবলে পড়েন যাত্রীরা। অথচ এমন বাস্তব সমস্যা মাথায় নিয়ে ট্রেনের প্ল্যাটফরম করা হয়নি।

গত এক যুগে কমলাপুর স্টেশন চার দফায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু এখনো সেখানে সব প্ল্যাটফরম ট্রেনের পাদানির সমউচ্চতায় করা হয়নি। ৫৩টি স্টেশনের প্ল্যাটফরম ট্রেনের উচ্চতায় করার জন্য কাজ চলছে, যা শুরুতেই করা উচিত ছিল।

বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেনে ভ্রমণ করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ট্রেনে টিকিট পরীক্ষার জনবল (টিটিই) নেই। ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনে পস মেশিন (পয়েন্ট অব সেলস) অপর্যাপ্ত। ফলে বিনা টিকিটে ভ্রমণ রোধে ‘টিকিট যার ভ্রমণ তার’ এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

ভুক্তভোগী যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন প্রতিবেদককে বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা যাত্রী পরিষেবার মানোন্নয়ন করা নিয়ে অনেক কথা বলে থাকেন।

কিন্তু মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ রেল সেবার গোড়ায় গলদ রয়েছে। সেবা ব্যবস্থা যাদের দেখভাল করার কথা তাদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতা নেই। রেল কর্মচারীদের অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে সব সময় ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এতে করে তাদের কাজও করা লাগে না

, আবার ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়ে উলটো খবরদারি করা যায়। এছাড়া নানা রকম স্বার্থ হাসিলের সুযোগ তো আছেই। ফলে চাকরি ফেলে তারা সারা বছর সরকারি দলের সভা-সমাবেশ নিয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন।

টিকিট বাণিজ্য : রেলে ৫ কিংবা ১০ দিন আগে দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট দেওয়া শুরু হলে আধা ঘণ্টার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। পরিসংখ্যান বলছে, যাত্রীবাহী ট্রেনের মোট আসনের বিপরীতে গড়ে ৭৭ শতাংশ টিকিট বিক্রি হচ্ছে। অবিক্রীত ২৩ শতাংশ সিটেও বিনা টিকিটে বসে গন্তব্যে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি চক্র সারা বছর সিস্টেম করে কালোবাজারে টিকিট বিক্রি কিংবা টিকিটবিহিন যাত্রী নিয়ে নিজেরা পকেট ভারী করেন। ৭০-৭৫ শতাংশ টিকিট বিক্রি হওয়ার পর তারা বাকি সিট সিস্টেম করে ব্লক দেন।

তখন টিকিটপ্রার্থীদের বলা হয়, সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। অথবা সিস্টেম অচল করে রাখা হয়। এরপর ট্রেন ছাড়ার সময় চক্রটি টিটিইদের ফোনে বলে দেন-কোন কোচে কোন কোন সিরিয়াল থেকে কতটি সিট খালি রয়েছে। তখন জরিমানা আদায়সহ প্রায় দ্বিগুণ দামে এসব সিট বিক্রি করা হয়। যার অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। সূত্র বলছে, যাত্রী পরিবহণে রেলে প্রতিদিন ৩৫৯টি ট্রেন চলাচল করে।

এসব ট্রেনে প্রায় ২ লাখ টিকিটধারী যাত্রীর সঙ্গে দ্বিগুণের বেশি বিনা টিকিটধারী যাত্রী চলাচল করেন। কিন্তু বড় ধরনের এই অনিয়ম বন্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং সব স্টেশনে টিকিট কাটার সময় টিটিই এবং আনসার সদস্যরা যাত্রীদের দ্রুত ট্রেন ছেড়ে যাবে বলে টিকিট না কেটে ট্রেনে ওঠার জন্য সুযোগ দেন।

এছাড়া ভিআইপি নামক সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালীদের কাছে সারা বছর রেলের কেবিনসহ বিশেষ শ্রেণির টিকিট এক রকম জিম্মি থাকে। যে কারণে অনেকে তাদের মুমূর্ষু রোগীদেরকেও কেবিনে নিতে পারেন না। এতে রেলের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি যাত্রীসেবাও চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।

সেবা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ফলে আগামী ঈদযাত্রায়ও এমন দুর্ভোগ থেকে যাত্রীদের পরিত্রাণ মিলবে না। মূলত রক্ষকই ভক্ষক হওয়ার কারণে কার্যত রেলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না।

এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সমিতি থেকে ২০১৬ সালে একটি জরিপ করেছিলাম, সেই জরিপে উঠে আসে ৮৭ শতাংশ ট্রেনযাত্রী রেলের সেবা ও নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট নন। ৭২ শতাংশ যাত্রী টিকিট কাটতে দুর্ভোগ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।’

তিনি বলেন, রেলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে সেবার মান যেমন বাড়বে না, তেমনি বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতি কমবে না।

সংস্কারের নামে হরিলুট : রেল স্টেশন উঁচু করাসহ নানা রকম সংস্কার কাজে চরম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে রেলভবনে। বিষয়টি প্রথমদিকে আমলে নেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে পরে তা থেমে গেছে। সূত্র বলছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মকর্তাদের একটি টিম সরেজমিন কাজ পরিদর্শন করে অভিযোগের সত্যতাও খুঁজে পায়।

কিন্তু পরে রহস্যজনক কারণে সব প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। এমনকি ওই লিখিত অভিযোগও গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন লিখিত অভিযোগ না, মৌখিক অভিযোগ পেয়ে তারা তদন্ত করেছেন। তবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, নিম্নমানের কাজ করার উদ্দেশ্যে রাতের আঁধারে স্টেশন সংস্কারের কাজ করা হয়। রাতে কাজ করতে নিষেধ করা সত্ত্বেও কোনো ঠিকাদার কর্ণপাত করেননি।

মূলত কাজের তদারকিতে দুই অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীদের সঙ্গে ঠিকাদারদের বিশেষ সখ্য থাকায় তারা মাঠপর্যায়ে কোনো কর্মকর্তাকে তোয়াক্কা করেন না। সংশ্লিষ্টরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সমাপ্ত হওয়া এবং চলমান প্রকল্পের কাজগুলো তৃতীয় পক্ষ দিয়ে যথাযথভাবে তদন্ত করালে থলের কালো বিড়াল বেরিয়ে আসবে।

কয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে : ট্রেনে শিডিউল বিপর্যয় নিয়ে নানা ধরনের হাস্যরস চালু আছে। কেউ কেউ বলেন, কাছের দূরত্বে যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষা না করে হেঁটে যাওয়া ভালো। তাহলেও আগেভাগে বাড়ি পৌঁছানো যাবে। কেউ আবার বলেন, ‘কয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে ভাই।’

তবে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা সারা বছর লেগে থাকে। যাত্রীদের অভিযোগ, প্রতিবছর ট্রেনে বরাদ্দ বাড়লেও সেবা বাড়ে না। গতি বাড়ে না ট্রেনের। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই লাইনচ্যুত, এতে বিলম্বের ট্রেন আরও বিলম্বে ছাড়ে। দেড় যুগ আগে রেলের বরাদ্দ ছিল ৬০০ কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে বরাদ্দ ১৮ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। এত বিনিয়োগেও ট্রেনের গতি বাড়ে না। বর্তমান ট্রেনের গতি গড়ে ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটারের নিচে। অথচ বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করে ১২০-১৪০ কিলোমিটার গতিবেগের ট্রেন ইঞ্জিন ও কোচ কেনা হয়েছে। যার সুফল জনসাধারণ পাচ্ছেন না।

চুরি হয় বদনা-বালিশও : হাতেগোনা কয়েকটি ট্রেনে মাঝে মধ্যে দেখা যায় টিস্যু রোল, বদনা, সাবান, চাদর এমনকি বালিশ পর্যন্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাত্রীরা বলছেন, যথাযথ মনিটরিং থাকলে ট্রেনের মধ্যে এভাবে চুরি হওয়ার কথা নয়। আসলে এ রকম ঘটনা দু-একটি ঘটলেও বাস্তবে চোরের ওপর দায় চাপিয়ে এসব লুটপাট করছেন ট্রেনের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সৎ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, খাতা-কলমে কেনাকাটা ও সরবরাহ দেখিয়ে রেলের প্রশাসন বিভাগ এবং টিটিইরা এগুলো টাকার অঙ্কে নিজেরা ভাগাভাগি করে নেন। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় এসব বড় চোরদের ধরার কোনো উপায় নেই।

ছাদ বেয়ে পড়ে পানি : ঢাকা-পঞ্চগড় রুটের একতা, দ্রুতযান ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগিতে বৃষ্টি হলেই ছাদ বেয়ে পানি পড়ে। ওই ট্রেনের জোহায়ের ইবনে কলিম নামে এক যাত্রী জানান, একতা এক্সপ্রেসে পাবর্তীপুর থেকে ঢাকায় আসছিলেন।

রাতে সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। ছাদ বেয়ে পানি পড়ায় সারা রাতই তিনি সিটে বসতে পারেননি। এ অবস্থা ছিল আরও কয়েকজন যাত্রীর। তিনি এর ভিডিওচিত্র ও ছবি যুগান্তরের কাছে সরবরাহ করেছেন।

এদিকে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ট্রেনের অভ্যন্তরে ছিনতাই-চুরির ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আকস্মিক ডাকাতের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অনেক ট্রেনযাত্রী। ফলে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত অন্তঃহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সঙ্গে নিয়ে চলেন যাত্রীরা।

গত এক যুগে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে ২ জন টিটিই, ১ জন প্রকৌশলীসহ পাঁচজন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ ২৫ মার্চ জয়দেপুর রেলস্টেশনের আউটারে পাথর নিক্ষেপে মৈত্রী এক্সপ্রেসের চালক তৌহিদুজ্জামানসহ ছয়জন আহত হন। এ ধরনের হামলার পেছনে চোরাকারবারি ও ছিনতাইকারী চক্র জড়িত। তারা ট্রেনের জানালা দিয়ে ওঠানামা করা ও যাত্রীদের মালামাল ছিনিয়ে নিতে এমন জঘন্য কাজ করে। এজন্য পাথর নিক্ষেপ করে জানালা ভেঙে ফেলতে তারা বিভিন্ন পয়েন্টে হামলা চালায়।

যে কারণে অধিকাংশ ট্রেনে জানালার গ্লাস ভাঙা অথবা নেই। এমনকি অ্যালুমিনিয়াম শাটার পর্যন্ত নেই। এগুলো অপরাধীরা ভেঙে নিয়ে গেছে। অথচ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। রেলপুলিশ থাকলেও তারা রেললাইনের ১০ ফিটের বাইরে যেতে পারে না। রাজশাহীগামী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যাত্রী সোনিয়া ইবনে ইমরান বলেন, ‘স্টেশন এবং ট্রেনের ভেতরেও নিরাপত্তা নেই। জানালার গ্লাস বন্ধ থাকলে, চিন্তা থাকে কখন গ্লাস ভেদ করে ঢিল এসে মুখে পড়বে। কেননা প্রায় সময় ট্রেনে ছোড়া পাথরে আহত হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা।

এতে অনেক যাত্রী মারাও গেছেন। কেবিন ছাড়া কোনো যাত্রীর একবার চোখে ঘুম এলে আর রক্ষা নেই। পাশে থাকা যাত্রীবেশী চোর ও ছিনতাইকারী চক্র মালামাল নিয়ে সটকে পড়ে। কোনো স্টেশনে ট্রেন আসামাত্র একটু আগে থেকেই তারা চলন্ত ট্রেন থেকে জানালা কিংবা দরজা দিয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি নিজেও এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।’

ফলে ট্রেনে যাত্রীসেবা নিয়ে বাহবা নেওয়ার কিছু নেই। সবই প্রতিদিন চোখের সামনে ঘটছে। অথচ এতসব প্রতিষ্ঠিত অভিযোগ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যাত্রীরা নাকি ‘অসীম সন্তুষ্টি’র মধ্যে ট্রেনে ভ্রমণ করেন। প্রায় ৩ মাস আগে এমন এক জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে বাংলাদেশ রেল কর্তৃপক্ষ। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।

রেলে যাত্রীসেবার মান নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুল হক। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সেবা তলানিতে। গত এক যুগে অত্যাধুনিক অনেক ইঞ্জিন-কোচ আনা হলো। কিন্তু তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।

ভারতীয় রেল ব্যবস্থার উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারতে রেল কিন্তু বেশ লাভজনক গণপরিবহণ। কিন্তু আমাদের দেশে লাগাতার লোকসান। এর প্রকৃত কারণ যতদিন উদ্ঘাটন না করা যাবে এবং এজন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে যতদিন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হবে না-ততদিন আমাদের রেলের এসব সমস্যার সমাধান হবে না।

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনে ঝড় তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন আহমেদ রনি। গত বছর তার অভূতপূর্ব আন্দোলন দেশ ছাপিয়ে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের দৃষ্টি কাড়ে।

প্রথমদিকে তিনি একাই আন্দোলন চালিয়ে গেলেও পরে সব পেশার মানুষ তার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। একপর্যায়ে রেল কর্তৃপক্ষ তার দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু তার কোনো দাবি শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহিউদ্দিন আহমেদ রনি যুগান্তরকে বলেন, যাত্রীসেবা-নিরাপত্তায় বড়ই বেখেয়ালি রেল। সবার দৃষ্টি শুধু প্রকল্পের দিকে। কারণ প্রকল্পের ‘মধু’ আহরণে তারা তৎপর।

তিনি বলেন, একজন যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ থেকে শুরু করে ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছা পর্যন্ত পদে পদে হয়রানি-দুর্ভোগের শিকার হন। কিন্তু এ বিষয়ে অভিযোগ দেওয়ার জায়গাও নেই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম