নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য আকাশছোঁয়া
সংসার তো আর চলে না
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফইল ছবি
এক বছরের ব্যবধানে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এর বিপরীতে অর্থনৈতিক মন্দায় বাড়েনি মানুষের আয়। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাকে খাবার উপকরণ কেনা কমাতে হচ্ছে। একই সঙ্গে কমাতে হচ্ছে ভ্রমণ, শিক্ষা, বিনোদনসহ অন্যান্য খাতের খরচ।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আয় ও ব্যয়ের মধ্য সমন্বয় করতে মানুষ প্রথমে দৃশ্যত অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব খারচ কমিয়েছে। এতেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় খাবারে হাত পড়েছে।
খাবার খরচ কমানোর ফলে বাড়ছে পুষ্টিহীনতা। এর প্রভাবে খর্বকায় শিশুর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতের খরচ কমিয়েও এখন সংসারের হাল ধরে রাখা যাচ্ছে না। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেকে বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউবা পরিবার-পরিজন গ্রামে পাঠিয়ে নিজে শহরে থাকছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশে মন্দা আগে থেকেই বিরাজমান ছিল। বৈশ্বিক মন্দার ধাক্কায় তা প্রকট আকার ধারণ করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। এখন এর প্রভাবের ধাক্কা আসছে ভোক্তার ওপর। মন্দার প্রভাবে গত এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। এতে আমদানি পণ্যসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ও বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান বাড়েনি। এমন কি যারা কর্মে ছিলেন তাদের অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। চাকরিরতদের মধ্যে অনেকের বেতন-ভাতা নিয়মিত হচ্ছে না। করোনার পর থেকে গত প্রায় ৩ বছরে বেতন বাড়েনি। আগের বেতনেই কাজ করছেন। ওই সময়ে পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি বাদ দিলে প্রায় সবারই আয় কমেছে। এর মধ্যে খণ্ডকালীন ও মৌসুমি কাজের মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় থেমে থাকেনি।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের বেসামাল দামে মধ্যবিত্ত অসহায়। তার চেয়ে বেশি অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ। দুই শ্রেণির মানুষ আয় দিয়ে পরিবারের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই ব্যয় সামলাতে খাবার কেনার বাজেট কাটছাঁট করছেন। এতে পুষ্টির অভাব হচ্ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আব্দুলাহ দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে থাকেন মালিবাগে। বেতন পান ৬০ হাজার টাকা। গত ২ বছর আগে এ টাকায় বেশ ভালোই চলতেন। কিন্তু এখন আর পারছেন না। সংসারের চাহিদা মেটাতে না পেরে প্রতিমাসেই ধার করছেন। বাসা ভাড়া ২২ হাজার টাকা, বড় ছেলে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রতি সেমিস্টারে তার খরচ ৪০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ ছেলেকে হাতখরচ দিতে হয় মাসে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। মাসে যাতায়াত খরচসহ স্কুল ফি ৭ হাজার টাকা।
এরপর পরিবারের ৫ সদস্যের জন্য মাসে চাল দরকার ৩৫-৪০ কেজি। ৬৫ টাকা কেজি ধরলেও প্রায় ২ হাজার ৬০০ টাকা লাগে। মাছ-সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে লাগে ১০ হাজার টাকা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল চার হাজার টাকা। এতেই বেতনের টাকা শেষ। এরপর নিজের অফিসে যাতায়াত খরচ, চিকিৎসা, ছেলেদের বই-খাতা, কলমসহ অন্যান্য ব্যয় তো আছেই। এসব ব্যয় মেটাতে আগে সঞ্চয় ভেঙেছেন। এখন ধার করছেন। সবকিছুর দাম বাড়তি থাকায় এখন মাংস তো কেনাই হয় না। আগে সপ্তাহে দু-তিন দিন মাংস থাকত। এখন থাকে ডিম আর সবজি। ডিমের দাম যেভাবে বেড়েছে সেটিও এখন আর প্রতিদিন থাকে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষ প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে মাছ, মাংস, ডিম ও ডাল। প্রোটিনের জোগান আসে এমন পণ্যের দাম গত এক বছরে বেড়েছে ২০.৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে রুই মাছের দাম ২১.২১ শতাংশ ও গরুর মাংসের দাম ২৪.৭৮ শতংশ।
ডালের কেজি গত এক বছরে ১৩০ থেকে বেড়ে ১৩৬ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৪.৬২ শতাংশ। ডিমের হালি ৩১.৫৮ শতাংশ বেড়েছে। ডালের দাম কম বাড়লেও ডিমের দাম বেশি বাড়ায় এটি এখন নিম্ন আয়ের মানুষের সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এর ওপর ভর করেছে মধ্য আয়ের মানুষ।
গত এক বছরে শর্করা জাতীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৩৫.৫১ শতাংশ। নাজিরশাইলের দাম ২০.২৯ শতাংশ, মোটা চালের ১৭.৯৫ শতাংশ ও আটা ৬৪.২৯ শতাংশ বেড়েছে। শিশু খাদ্যের দাম ৩৬.০৫ শতাংশ। এর মধ্যে চিনির কেজি ৪৩.৫৩ শতাংশ, মিল্কভিটার দুধ প্রতি লিটার ২৮.৫৭ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিন তেল লিটারে সাড়ে ১৮ শতাংশ, আলুর কেজি ১২ শতাংশ বেড়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পণ্যের দাম বাড়ায় মানুষের ভোগের প্রবণতা কমে গেছে। এর মধ্যে চাল, প্রোটিন ও ভোজ্যতেলের ব্যবহার কমেছে। অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে সংকট বিদ্যমান রয়েছে। তাদের আয় কম, খাদ্যের দাম বেশি, তাই চাহিদামতো খাবার কিনতে পারছেন না।
খাবারের পাশাপাশি অত্যবশ্যকীয় সেবার দাম বেড়েছে লাগামহীন। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম দুই দফায় বেড়েছে ১০ শতাংশ। গ্যাসের দাম দুই দফায় বেড়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্য সব পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গণপরিবহণের ভাড়া প্রায় শতভাগ। এসব মিলে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে লাগামহীন।
কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার বাসিন্দা মো. নাজিমুল ইসলাম একটি চায়ের দোকান চালান। গত ৫ মাস আগেও তার দোকান পণ্যে ভরপুর ছিল। কিন্তু এখন প্রায় শূন্য অবস্থা। তিনি জানান, ৫ মাস আগেও মাসে প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন মাসে ১০ হাজারও থাকছে না। বিক্রি অনেক কমে গেছে। এই আয় দিয়ে এখন সংসার চলে না। ছেলেমেয়ে একটু মাংস খেতে চাইলেও নিতে পারি না।
বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারিতে ৩০৭ টাকায় যে পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত এখন তা কিনতে লাগছে ৩৩৩ টাকা। আলোচ্য সময়ে দাম বেড়েছে ৮.৫৭ শতাংশ। একই সময়ে খাদ্য উপকরণের দাম ৩৩৪ থেকে বেড়ে ৩৫৯ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ৭.৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম ২৭৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। বেড়েছে ৯.৮৪ শতাংশ। বাড়ি ভাড়া ও জ্বালানি খাতে ব্যয় ২৩৪ থেকে বেড়ে ২৯১ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৭.৭১ শতাংশ। চিকিৎসা খাতে ব্যয় ২৫৩ থেকে বেড়ে ৩০৪ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ১৯.৭৮ শতাংশ।
এসব ব্যয়ের বিপরীতে মজুরি বেড়েছে খুবই সামান্য। মজুরি ১৯৩ থেকে বেড়ে ২০৭ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। অথচ ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। ঘাটতি থাকছে দেড় শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে খাবারসহ বিভিন্ন খাতে খরচ কমানোর পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সংসার চালাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। ফলে তারা সঞ্চয় করতে পারছেন না। এমন কি আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে জাতীয় সঞ্চয়ে টান পড়েছে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিজেদের হাতে রাখছে। গত অর্থবছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের পরিবর্তে মানুষের হাতে থাকা টাকা বেড়েছিল ১ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়েছে ৩১ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে বেশি টাকা এখন মানুষের হাতে চলে এসেছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে ২ ধরনের অপুষ্টির শিকার। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগজনিত পুষ্টিহীনতা। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতার মধ্যে রয়েছে, শিশুরা খর্বকায় ও কম ওজনের হচ্ছে। খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগের মধ্যে স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ও বেশি বয়সে হাড় নরম হয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
এফএও’র প্রতিবেদনে অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের গড়ে ২-৩ টেবিল চামচ তেল খাওয়া দরকার। এছাড়া প্রতিদিন ২৭০ থেকে ৪৫০ গ্রাম চাল, আটা, ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম মিশ্র শাক-সবজি, ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম মাছ, মাংস, ডিম খেতে হয়। এ হিসাবে নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য গ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে তারা নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।