৪৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহিদ মিনার
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![৪৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহিদ মিনার](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2023/02/20/image-646923-1676837941.jpg)
দেশের দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে সাড়ে ৭ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু ১৩৫ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠানটি এখনো কোনো শহিদ মিনার পায়নি। শহিদ মিনার তৈরির লক্ষ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রথমে স্থানাভাবে নির্মিত হয়নি। এখন স্থান থাকলেও নির্মাণকাজ শুরু করা হচ্ছে না। কবে নাগাদ নির্মাণ শুরু হবে মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতির মিনার, সেটিও জানেন না প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, দেশের কতটি মাধ্যমিক ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার আছে, সেই তথ্যও নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে দেশের প্রায় ৩৮ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের মধ্যে কতটিতে শহিদ মিনার নেই, তা জানা সম্ভব হয়নি। সূত্রমতে, বিভিন্ন কলেজে শহিদ মিনার থাকলেও অধিকাংশ স্কুল ও মাদ্রাসায় শহিদ মিনার নেই। এ সংখ্যা অন্তত ২০ হাজার হবে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সূত্র জানিয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার। এর মধ্যে ২৪ হাজার বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নেই বলে জানান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) সিনিয়র সিস্টেস অ্যানালিস্ট অনুজ কুমার রায়। তিনি যুগান্তরকে জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহিদ
মিনারসংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করেন তারা। উল্লিখিত হিসাব অনুযায়ী, দেশে অন্তত ৪৪ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নেই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেক বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার তৈরির জন্য ২০০৮ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সেই হিসাবে ইতোমধ্যে ১৪ বছর সময় কেটে গেছে। এখনো যদি অর্ধলাখ প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার না থাকে, সেটা অপ্রত্যাশিত। তিনি বলেন, বায়ান্ন আর মহান ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। এটা আমাদের গৌরবের ইতিহাস এবং মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এদেশের সব স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে। শহিদ মিনার একটা প্রতীকমাত্র। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না থাকলেও শহিদ দিবস উদ্যাপন বন্ধ থাকে না। অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহিদ মিনার তৈরি করে শিক্ষার্থীরা এই দিবসটি পালন করে আসছে। কিন্তু যখন ইউনেস্কো আমাদের এই দিবসকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে, তখন এই শহিদ মিনার নির্মাণ করা জরুরি। আর এর জন্য বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয় না। তাই কোনো অজুহাতে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।
২০০৮ সালে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও শহিদ মিনার নির্মাণের বিষয়টি সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ২০১০ সালে। ওই বছরের ২৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসসমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা তৈরি ও প্রকাশ এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদাসহ আটটি নির্দেশনা দেন হাইকোর্টের বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ। অন্যদিকে গত বছরের ১৪ জুন এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। তাতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাঠামো অনুসরণ করে দেশে-বিদেশে সর্বত্র একই ধরনের শহিদ মিনার নির্মাণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
ইতোমধ্যে অবশ্য শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শহিদ মিনার নির্মাণে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা বা আনুষ্ঠানিক অর্থ বরাদ্দের তথ্য পাওয়া যায়নি। মাউশির ২০১৬ সালের এক অফিস আদেশে দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শহিদ মিনার নির্মাণ ও সংস্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক (কলেজ-৪) ড. মো. আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, দেশের যেসব সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শহিদ মিনার নেই, সেসব স্কুলে অতি দ্রুত শহিদ মিনার নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া যেসব স্কুলে শহিদ মিনার জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, সেগুলো যথাসম্ভব দ্রুত সংস্কার করতে হবে। ২০২০ সালেও একই ধরনের একটি নির্দেশনা জারি করে সংস্থাটি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অর্ধেক প্রতিষ্ঠানেও শহিদ মিনার নির্মিত হয়নি। এ ব্যাপারে একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও তা থমকে আছে। বিষয়টি মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, কতটি প্রতিষ্ঠানে শহিদ মিনার নেই, সেই তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে নিজস্ব বা স্থানীয় অর্থায়নে শহিদ মিনার তৈরির ব্যাপারে নির্দেশনা আছে।
পটুয়াখালীর সরকারি জুবিলী স্কুলের প্রস্তাবিত শহিদ মিনারের অর্থায়ন করছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, যেসব বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নেই, সেখানে তা নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। সেটি অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনো বিদ্যালয় যদি শহিদ মিনার তৈরি করার জন্য টাকা চায় তবে সংস্কার ও মেরামত খাত থেকে তা সংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। আমরা এ পর্যন্ত ২ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠানে এ খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ করেছি।
এদিকে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শহিদ মিনার নির্মাণে নির্দেশনা দিয়েছে ডিপিই। সংস্থাটি সম্প্রতি সারা দেশে অভিন্ন শহিদ মিনার তৈরির জন্য ডিজাইন পাঠিয়েছে। তবে এ খাতে বরাদ্দ না থাকায় স্কুল-কমিউনিটির যৌথ উদ্যোগে তা নির্মাণ করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিপিই পরিচালক মনীষ চাকমা যুগান্তরকে বলেন, এ নিয়ে একটা কমিটি কাজ করছে। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পর বিচ্ছিন্নভাবে অনেক বিদ্যালয় নির্মাণ করে ফেলেছে। পরে কমিটি থেকে এক বছর আগে শহিদ মিনারের দুটি ডিজাইন করে দেওয়া হয়েছে। মূলত দুটি সমস্যার কারণে শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ এগোচ্ছে না। প্রথমত, সব বিদ্যালয়ে শহিদ মিনার নির্মাণের জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত, এ খাতে বরাদ্দ নেই। তবে বিদ্যালয়গুলোয় অন্যান্য খাতে প্রচুর বরাদ্দ যায়। কমিউনিটির অংশগ্রহণে বিদ্যালয় শহিদ মিনার নির্মাণ করতে পারে। সেই অনুমতি দেওয়া আছে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের বরইতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে শহিদ মিনার তৈরির বরাদ্দ তারা পাননি। কিন্তু সরকার বিদ্যালয় চালানোর জন্য বছরে ‘স্লিপ’ নামে যে তহবিল দেয়, সেখান থেকে অর্থ নিয়ে তারা একটি শহিদ মিনার তৈরি করেছেন। অন্যরা চাইলে এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে পারে।