মাঠে আওয়ামী লীগ, নেই শরিকরা
শেখ মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিএনপিসহ তাদের সমমনা শরিকদের বিপরীতে মাঠের রাজনীতিতে এককভাবে সক্রিয় ক্ষমতাসী আওয়ামী লীগ।
দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু, সুহৃদ ও সমমনা বলে পরিচিত ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে দেখা যাচ্ছে না তাদের পাশে।
অথচ একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন এবং একসঙ্গে সরকার গঠন-এমন ভিত্তির ওপর প্রায় আড়াই যুগ আগে গড়ে উঠেছিল এই জোট।
আরেক পরীক্ষিত বন্ধু বলে বিবেচিত জাতীয় পার্টিও শাসক দলটির পাশে এখন নেই। মাঝে মধ্যে একসঙ্গে বিভিন্ন দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালন ছাড়া আওয়ামী লীগের পাশে কার্যত ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা কেউই নেই।
ফলে নিজেদের একক শক্তির ওপর ভর করে দলটিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে মাঠের বিরোধী পক্ষকে।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়সহ চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে গণসমাবেশ করে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি।
এরই ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসাবে গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় গণসমাবেশের কর্মসূচি পালন করে দলটি। পরদিন ১১ ডিসেম্বর বিএনপিদলীয় সংসদ-সদস্যরা সংসদ-সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এখানেই শেষ নয়। ধারাবাহিকভাবে গণসমাবেশ, গণমিছিল, অবস্থান কর্মসূচি, পদযাত্রাসহ একের পর এক কর্মসূচি পালন করে চলেছে।
পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও একই দাবিতে বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যুগপদ আন্দোলনে আছে।
এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ নিজেদের অবস্থান জানান দিতে এককভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপিসহ তাদের শরিক দলগুলোকে মোকাবিলার চেষ্টা করছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও তাদের সমমনা শরিকরা। একইদিন আওয়ামী লীগও ইউনিয়নর পর্যায়ে শান্তি সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে। ওই কর্মসূচি কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই পক্ষের মধ্যে হামলা-পালটা হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ শুক্র ও শনিবার দেশের ১৩টি সাংগঠনিক মহানগরে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপিসহ সমমনা দল ও জোট। অন্যদিকে শুক্রবার ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এবং শনিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশের পৃথক দুটি কর্মসূচি পালন করে। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের জেলায় জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি ও তাদের সমমনা শরিকরা। একইদিন পৃথক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।
আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শরিকরা শিগগিরই একসঙ্গে মাঠে নামবে জানিয়ে দলটির উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও ১৪ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু রোববার যুগান্তরকে বলেন, আমরা বসে নেই। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করছি বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী অপশক্তিকে মোকাবিলায় শিগগিরই আমরা একসঙ্গে রাজপথে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকব।
বিএনপি যেদিনই কর্মসূচি দেয়, সেদিনই আওয়ামী লীগ কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে দলটির এই এককভাবে মাঠে থাকা, শরিক দলগুলোর পাশে না থাকা নিয়ে রাজনীতির অন্দরমহলে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা চলছে। যদিও বিএনপির সংসদ-সদস্যদের সংসদ থেকে পদত্যাগের কারণে শূন্য হওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের দুই শরিক দলকে দুটি আসন ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে একটি আসন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিকে, আরেকটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদকে দেয় তারা। তবে এই নির্বাচনে জাসদের প্রার্থী জয়ী হলেও হেরে যান বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই উপনির্বাচন ছাড়া ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আওয়ামী লীগের পাশে দেখা যায়নি। তবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উদযাপন, মে দিবস-এ ধরনের দিবসভিত্তিক আলোচনাসভাগুলো একসঙ্গে করে আসছে তারা। সর্বশেষ রোববার ১৪ দলীয় জোটগতভাবে রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়। একইভাবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। পরের দুটি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। এখন জাতীয় পার্টিও বলছে, মহাজোট বলে এখন আর কিছু নেই। তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গেও নেই।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি রোববার যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে বিরোধী দলকে মোকাবিলায় তারা একাই যথেষ্ট। এ কারণে আমাদের তারা ডাকার প্রয়োজন মনে করে না। এ ইস্যুতে তারা কোনো আলাপ-আলোচনাও প্রয়োজন মনে করে না। আমরাও আগ বাড়িয়ে তাদের কিছু বলতে যাই না। তবে বিএনপি-জামায়াত জোটসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তিকে মোকাবিলায় আমরা আমাদের মতো করে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে মাঠে আছি।
তাহলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট কি কেবল নির্বাচনি জোটেই সীমাবদ্ধ-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই বামপন্থি রাজনীতিক বলেন, এই জোট যে নির্বাচনি জোট-তাও তো সঠিকভাবে বলা যায় না। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যেসব জায়গায় আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারবে না-এমন কিছু আসন তারা জোটের শরিকদের ছেড়ে দেয়। এরপর নির্বাচনের সময় দেখা যায় তাদের (আওয়ামী লীগ) দলের নেতাকর্মীরা টাকা-পয়সার বিনিময়ে জোটের বিপক্ষে থাকা প্রার্থীর হয়ে ভোটের মাঠে কাজ করে। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কার্স পার্টিকে একটি আসন ছেড়ে দেয়। বাস্তবে দেখা গেছে, দলটির নেতাকর্মীরা টাকার বিনিময়ে অন্য দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। এর সপক্ষে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণও আমাদের হাতে আছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের আরেক প্রধান শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিগোষ্ঠী মোকাবিলায় আমরা আমাদের মতো করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও যে যার মতো করে মাঠে আছে। তবে এটা ঠিক একসঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের কর্মসূচি নেই। শিগগিরই আমরা একসঙ্গে বসে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি রোববার যুগান্তরকে বলেন, মহাজোট বলে এখন আর কিছু নেই। এটা অতীত। আমরা এখন আমাদের মতো করে পথ চলছি। সংসদে এবং সংসদের বাইরে সরকারের সমালোচনা করছি। পাশাপাশি আগামীতে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি।