ঢাকার বায়ু খুবই বিপজ্জনক
মুসতাক আহমদ
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী ঢাকার বায়ুর মান বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে। বিগত জানুয়ারি মাসে একদিনও নির্মল বায়ু পায়নি এই শহরের মানুষ। এ মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ১০ দিনই ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে ছিল বাতাসের মান। বাকি ২১ দিন ছিল ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। শুধু তাই নয়, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের গেল ৬ দিনেও বায়ুমানে তেমন উন্নতি নেই। চরম অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে মেগাসিটির মানুষ। জানুয়ারি মাসে জন্ম নেওয়া শিশুটিও পৃথিবীতে এসেই দূষিত বা অস্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করে চলেছে। বায়ুদূষণ সম্পর্কে রোববার হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।
ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস রাজধানীর বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে থাকে। তাদের গত ৭ বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বায়ুমানের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল এবারের জানুয়ারি। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই সাত বছরে জানুয়ারি মাসের মোট ২১১ দিনের বায়ুমান রেকর্ড করা হয়। তাতে দেখা যায়, মানুষ একদিনও নির্মল বায়ু পায়নি। এর চেয়েও উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, দিন দিন বায়ুর মান ‘ভয়ানক’ রূপ ধারণ করছে। এর আগে ২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে ৩১ দিনের মধ্যে ৭ দিন বাতাসের মান ছিল ‘বিপজ্জনক’ (হ্যাজার্ডাস) পর্যায়ে। সেখানে এবার তা ১০ দিনে উন্নীত হয়। তার আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ দিন এবং ২০১৮ থেকে ২০২০ সালে তিন বছরের জানুয়ারি মাসের ৪ দিন করে বাতাসের মান বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। গত বছর মাত্র একদিন এমন অবস্থা ছিল ঢাকার বাতাসের। অর্থাৎ এবারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ যাচ্ছে।
ঢাকার বাতাস নিয়ে নিবিড় গবেষণা করেন বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। জানতে চাইলে সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, রেললাইন ছেড়ে ট্রেন কখনো সড়ক-মহাসড়কে চলে আসে না কেন? কারণ হচ্ছে, তার একটি ‘ডেডিকেটেড লাইন’ (উৎকৃষ্ট বা সুনির্দিষ্ট) আছে। কিন্তু বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণে তেমন কিছু নেই। মনে হচ্ছে, এটা বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। সর্বোচ্চ আদালত সর্বশেষ রোববার এ নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। বায়ুদূষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। এর আগে একাধিকবার এ নিয়ে আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আসলে ঢাকার মানুষকে রক্ষায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সংস্থাগুলো ‘ডেডিকেটেড’ না হলে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ লাভের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হচ্ছে।
বিশ্বের নানা সংস্থা বিভিন্ন বৈশ্বিক পর্যায়ে বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে অধিকাংশ দিনই ঢাকা বিশ্বের এক নম্বর দূষিত শহরের তালিকায় ছিল। এই সংস্থার গত কয়েক বছরের প্রতিবেদনেও একই চিত্র বেরিয়ে আসছে। আর সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের এক গবেষণায় দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকে।
আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মান মাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে বছরের ৩১৭ দিন। মাঝে মধ্যে এটা ‘অস্বাস্থ্যকর’ থেকে ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু এবারের জানুয়ারিতে পরিস্থিতি আরও খারাপ পর্যায়ে নেমে যায়। সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা ও গ্যাসীয় পদার্থকে ‘সহনীয়’ মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
কিন্তু সোমবার রাত ৭টায় একিউআই’র ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে এর পরিমাণ ১৫৮ মাইক্রোগ্রাম, যা প্রায় তিনগুণ। আর গত ২৪ জানুয়ারি সারাদিন পর্যবেক্ষণ করে আরও উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যায়। সেটি অনুযায়ী, সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ২৭৬ মাইক্রোগ্রাম ছিল। এরপর দুপুর ১টা, বিকাল ৪টা ও ৫টায় ছিল যথাক্রমে ২৫৩, ২৪৩ এবং ২৩২ মাইক্রোগ্রাম। সন্ধ্যা ৬টায় তা বেড়ে আবার ২৪০ মাইক্রোগ্রাম হয়েছে। সাধারণত রাতে বাতাসে দূষণ কমে যায়। কিন্তু ওই তারিখে সারাদিনই দূষণে ঢাকা বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছিল।
বায়ুমানের মোট ৬টি স্তর আছে। এগুলো হচ্ছে-‘ভালো’ (৫০ মাইক্রোগ্রাম), ‘সহনীয়’ (১০০), ‘স্পর্শকাতর গ্রুপের জন্য অস্বাস্থ্যকর’ (১০১-১৫০), ‘অস্বাস্থ্যকর’ (১৫১-২০০), ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ (২০০-৩০০) এবং ‘বিপজ্জনক’ (৩০০-এর বেশি)। প্রথম তিনটিকে ‘সীমার মধ্যে’ দূষণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু গত ৭ বছরের ৭টি জানুয়ারি মাসে প্রথম তিনটি মান মাত্রার মধ্যে শুধু তৃতীয় মাত্রার (স্পর্শকাতর গ্রুপের জন্য অস্বাস্থ্যকর) বায়ু পাওয়া যায় ২ দিন।
ঢাকায় অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাপস বায়ুদূষণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছে। তাতে দেখা যায়, ঢাকার গত ৭ বছরের (২০১৭ হতে ২০২৩) বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিপজ্জনক পথে যাচ্ছে। গত ৭ বছরের জানুয়ারি মাসের ২০৯ দিনের মধ্যে ৩৫ দিন ‘বিপজ্জনক’ এবং ১৪৫ দিন ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ দিন ছিল। একই সময়ে ঢাকার মানুষের একদিনের জন্যও ভালো বায়ু সেবন করার সৌভাগ্য হয়নি। শতকরা ৯৯.০৪ ভাগ দিনই বায়ুমান পরিস্থিতি ‘অস্বাস্থ্যকর’ থেকে ‘বিপজ্জনক’ বা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল। ক্যাপস আরও বলছে, গত সাত বছরে ঢাকার জানুয়ারি মাসের মধ্যে বায়ুর মানের দিক থেকে ২০২২ সালে ১৮ দিন খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ২১ দিনই ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল।
এদিকে গবেষণায় সম্প্রতি ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত কিছু রোগও বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাতাসের মাধ্যমেও এই রোগের অণুজীব বা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে বস্তি এলাকায় যেমন এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তেমনি ধানমন্ডির মতো আবাসিক এলাকায়ও এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সম্প্রতি ঢাকার ১৬ স্থানে ১২৮টি স্যাম্পল নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করে দেখেছে. এভাবে অণুজীব ভেসে বেড়ানোর ফলে এলার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, চোখের রোগসহ প্রতিনিয়ত নানান রোগ ছড়াচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে ঢাকার বাতাস এত দূষিত কেন। এর জবাবে ক্যাপস পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার বাতাসে বস্তুকণা ২.৫ নামের অতি সূক্ষ্ম পদার্থ স্বাভাবিকের চেয়েও ৫ গুণ বেশি ভেসে বেড়াচ্ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালের ধারাবাহিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরে ওই দূষণ বেড়েছিল ১০ শতাংশের বেশি। এই অবনমন দিন দিন বাড়ছেই। তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণে মূলত বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজ প্রধান ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে নির্মাণ খাত ও ইটভাটা অন্যতম। ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে রমনা থানা পর্যন্ত রাস্তা গত ৩৫ দিন কাটা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। যানবাহন চলাচল করায় সেখানকার পরিবেশ ধুলোয় ধূসরিত। এই মুহূর্তে ঢাকার ১২২ স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। প্রত্যেক স্থানের অবস্থা একইরকম।
মুন্নু মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিয়াউল হক যুগান্তরকে বলেন, বায়ুদূষণ অসংক্রামক রোগগুলোর অন্যতম কারণ। দূষিত বায়ু থেকে সাধারণত ফুসফুসজনিত রোগ হয়। এর মধ্যে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট অন্যতম। মানসিক চাপ বা উচ্চরক্তচাপও অনেক সময়ে বায়ুদূষণ থেকে হতে পারে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণে ফুসফুসে সংক্রমণ, হৃদরোগ ও ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ২৩ শতাংশ স্ট্রোক ও ৩২ শতাংশ হার্ট ফেইলরের কারণ বায়ুদূষণ। এলঝেইমার্স ও পারকিন্সন জিজিও হয় বায়ুদুষণের ফলে। শিশু, বয়স্ক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।
বায়ুদূষণ রোধে আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে: শেখ ফজলে নূর তাপস
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, বায়ুদূষণে ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষে অবস্থান করছে। এটা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে সুখকর অভিজ্ঞতা হতে পারে না। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ ও বাস্তবিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।
এছাড়াও প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর নিবিড় তদারকি ও ভূমিকা আরও বলিষ্ঠ হতে হবে।
মেয়র বলেন, রাজধানীতে যেসব যানবাহন চলাচল করে সেগুলোর অধিকাংশই মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার করে না। ফিটনেস নেই, নিুমানের লুব্রিকেন্ট ব্যবহার এবং এগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয় না। এ ধরনের যানবাহন থেকে ক্ষতিকর কার্বন মনোক্সাইড, ডাইঅক্সাইড, সিসা, সালফার, কার্বন, ওজোন, নাইট্রোজেন অক্সাইড বের হয়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে। এসব যানবাহন বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ দায়ী। জনঘনত্ব বিবেচনায় ঢাকা শহরে এসব বিপজ্জনক ধাতু ও যৌগ পদার্থের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। এছাড়াও প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের সময় কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়াও বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও খোঁড়াখুঁড়িকে অনেকে বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করে থাকে। কিন্তু বাস্তবে নির্মাণসংশ্লিষ্ট কাজ, সড়ক সংস্কার ও খোঁড়াখুঁড়ির ফলে সৃষ্ট ধুলাবালির পরিমাণ ১০ শতাংশের মতো।
তিনি বলেন, বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দায়িত্বানুযায়ী কাজ করছে। খেয়াল করলে যে কেউ বুঝতে পারবে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সম্পন্ন করা হয়। এখন যখন-তখন কোনো সংস্থা নিজেদের মতো করে আর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করতে পারে না। ডিএসসিসির সঙ্গে সমন্বয় করেই সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হচ্ছে। এতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ অনেকাংশেই কম। এসব কার্যক্রম বর্তমানে গভীরভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী সড়কে পানি ছিটানো হচ্ছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেজন্য বলা যায়, বায়ুদূষণ রোধে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কাজ করে চলেছে। এরপরও বলব, নির্মাণসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে আরও অধিক পরিমাণে তদারকির উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হবে।
ঢাকার আশপাশের ইটভাটাগুলো দায়ী: মো. আতিকুল ইসলাম
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঢাকার আশপাশের ইটভাটা। গবেষণা অনুসারে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলা দ্বারা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়াও ঢাকার বায়ুতে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি বেড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ধুলাবালি নিবারণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অত্যাধুনিক স্প্রে ক্যাননের মাধ্যমে পানি ছিটাচ্ছে। দুটি স্ট্রে ক্যানন ডিএনসিসি এলাকার মহাসড়কে পানি ছিটানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিএনসিসির আওতাধীন পুরো এলাকার মহাসড়ককে দুটি ভাগে ভাগ করে একদিন অন্তর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দুটি মেশিন দিয়ে পানি ছিটানো হচ্ছে।
মহাসড়ক ছাড়াও ডিএনসিসি এলাকার অন্য সড়কগুলোতে ১০টি ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে প্রতিদিন সকালে ও বিকালে দুইবার পানি ছিটানো হয়। নির্মাণাধীন সড়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণ পানি ছিটানো হয়।
নির্মাণকাজ চলাকালীন ঠিকাদাররা যেন মাটি ঢেকে রেখে কাজ করে সে নির্দেশ দেয়া হয়। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র রেখে পরিবেশ দূষণ করলে ডিএনসিসির ম্যাজিস্ট্রেট আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেল, বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়েসহ চলমান অন্যান্য প্রকল্প ও যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় ধুলাবালির কারণে যাতে বায়ুদূষণ ও পরিবেশের ক্ষতি না হয় সেজন্য নির্দেশ দেওয়া আছে। ইটের ব্যবহার বন্ধ করে সিমেন্টের ব্লকের ব্যবহার করতে হবে। প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সব সংস্থার সমন্বয়ে বায়ুদূষণ কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে: অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান
বায়ুদূষণ এখন আর কেবল ফুসফুসজনিত রোগের কারণ নয় বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে মানসিক বা উচ্চরক্তচাপসহ মানব দেহের বহুমাত্রিক সমস্যা ও রোগের কারণ হিসাবেও বায়ুদূষণকে চিহ্নিত করে থাকেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সুতরাং, বায়ুদূষণ বর্তমানে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সম্পর্কে নীতি-নির্ধারকদের সতর্কতা কাম্য।
তিনি বলেন, বায়ুদূষণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া বা স্বাস্থ্যঝুঁকি হচ্ছে- সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ। এর কারণে ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ঢাকা শহরের কিছু স্থানে নমুনা বিশ্লেষণে ২০০ প্রকার জৈব যৌগ শনাক্ত করা গেছে। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়স্ক আর শিশুরা।
ঢাকার বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার মধ্যে অন্যতম অতিরিক্ত সিসা। এটা শিশুর মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের রক্ত পরীক্ষায় ৮০ এমজি/ডিএল থেকে ১৮০ এমজি/ডিএল সিসা পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার সাত থেকে ১৬ গুণ বেশি। আর ঢাকা শহরে পরিবহণ খাতে কর্মরত ব্যক্তিদের রক্তে প্রায় ২০০ এমজি/ডিএল সিসার উপস্থিতি বিদ্যমান।
ক্রমবর্ধমান সিসাদূষণ মানব দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। এ ছাড়া কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। সিসাদূষণের কারণে শিশুরা বড়দের তুলনায় তিনগুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া সাম্প্রতিক গবেষণায় বাতাসের মাধ্যমে অণুজীব বা ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে অ্যালার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, চোখের রোগসহ প্রতিনিয়ত নানান রোগ ছড়াচ্ছে। ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত কিছু রোগও বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কর্মরতদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগের উপসর্গের দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা বেশি করে খাবার পানি পান করবেন। বাইরে বের হলে মাস্ক পরবেন। অ্যাজমা ও সিওপিডির রোগী ছাড়াও যে কেউ সিজনাল বিভিন্ন ভ্যাকসিন যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে পারেন। আর একটি বিষয় হলো, কফ, সর্দি আটকিয়ে বেশিক্ষণ জমিয়ে রাখা যাবে না। সাধারণ চিকিৎসায় সর্দি, কাশি ভালো হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জ্বর, বুকব্যথা ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।