সানেমের অর্থনীতিবিদ সম্মেলন
ব্যাংক খাতের সংস্কারসহ ১০ চ্যালেঞ্জে অর্থনীতি
সংস্কার তো বিপ্লব নয় যে রাতারাতি হয়ে যাবে -ড. শামসুল আলম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কোভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রধান ১০টি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বৈষম্য বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার এবং আর্থিক খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা। এগুলো মোকাবিলায় ব্যাপক সংস্কারসহ আইএমএফ-এর শর্তের কার্যকরী বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবে সংস্কারের পেইন বা ব্যথা যাতে শুধু নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর না আসে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমানো সহজ বিষয় নয়, এটি কমানো রাজনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু কাগজে সই করলেই খেলাপি ঋণ কমবে না।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর ষষ্ঠবার্ষিক অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। শনিবার দুদিনের সম্মেলন শুরু হয়েছে। এদিন বিভিন্ন অধিবেশনে দেশি-বিদেশি ৪০টির মতো গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে-‘বিল্ডিং রেজিলিয়েন্স টু শকস: প্রিউরিটিস, চ্যালেঞ্জ অ্যান্ড প্রসপেক্টস’।
রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে আয়োজিত সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। সানেমের চেয়ারম্যান ড. বজলুল হক খন্দকারের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এ পর্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। অপর একটি অধিবেশনে ড. সেলিম রায়হানের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান এবং অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।
সম্মেলনে তুলে ধরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্য চ্যালেঞ্জগুলো হলো-প্রবৃদ্ধি অর্জনের নতুন পথ বের করা, রপ্তানি পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সংস্কার এবং জিডিপির তুলনায় কর হার বাড়ানো। আরও আছে সময়মতো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শামসুল আলম বলেন, আইএমএফ আমাদের কোনো শর্ত দেয়নি। তারা বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। যেসব পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যৌক্তিক। তবে সংস্কার তো বিপ্লব নয় যে রাতারাতি হয়ে যাবে। সংস্কার হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। সংস্কার যন্ত্রণাদায়ক হলেও ইতোমধ্যেই বেশকিছু ক্ষেত্রে সেটি করায় আইএমএফ আমাদের ঋণ দিয়েছে। চলমান সংস্কারের কারণে দেশে দারিদ্র্য বাড়ার আশঙ্কা নেই। এর কারণ হলো, গ্রামীণ এলাকায় বেকারত্ব নেই। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আইএমএফ ঋণ দেওয়ায় অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণ দিতে উৎসাহ পাচ্ছে। ইতোমধ্যেই এআইআইবি বাজেট সহায়তা দিয়েছে। আরও আড়াই বিলিয়ন ডলার দেবে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি ভালো হচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, ঋণ গ্রহণের হার, বিদ্যুৎ সুবিধা, নারীদের কর্মে নিযুক্তি, গড় আয়ু, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু রোধ, মানব উন্নয়ন সূচক অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় ভালো অবস্থানে আছি আমরা। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ৬ মাসে তুলনামূলকভাবে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। কাজেই আমাদের রিজার্ভ আর পড়বে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক দেশেই ভিন্ন ডলার রেট আছে। তাই প্রবাসীদের জন্য আমাদের দেশে ডলার রেট কিছুটা বেশিই থাকবে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই আছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়মিত হচ্ছে।
রেহমান সোবহান বলেন, সরকারি নীতিই অনেক সময় মানুষকে দরিদ্র করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এ খাতে লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে আর গুটিকয়েক মানুষ ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যান। সেগুলো আর ফেরত আসে না। সরকারি নীতিতে আবার ২ শতাংশ দিয়ে রিশিডিউল করার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদানি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি আছে, সেটি স্মার্ট চুক্তি হয়নি। এই চুক্তি সংশোধনের সুযোগ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, রপ্তানি শুধু পোশাক খাতনির্ভর। এখানে বহুমুখীকরণ করতে হবে। মানবসম্পদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আদম ব্যবসায়ীদের কারণে অভিবাসন খরচ বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা দেশে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। দেশে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য শুধু ভালো ভালো নীতিমালা করলেই হবে না। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ভালো সরকার। সরকার এখন দেশকে স্মার্ট করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। তিনি বলেন, ভাবা হচ্ছে কোভিড এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আসলে এই সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তা আমাদের অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব ফেলছে।
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বড় কথা নয় বরং দেখতে হবে, প্রবণতা কী। রিজার্ভের প্রবণতা নিচের দিকে নামতে থাকলে ঠেকানো কঠিন। দেশের রিজার্ভ একসময় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারও ছিল। তাই বলছি, পরিমাণ অনেক সময় বড় সমস্যা নয়, প্রবণতাটাই বড় কথা। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিতে অনেক শর্তের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর কথাও আছে। আইএমএফ বলেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু খেলাপি ঋণ অনেক দশক ধরে দেখেছি, শুধু কাগজে সই করলেই কি খেলাপি ঋণ কমে যাবে? এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার। খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দেওয়ার মাধ্যমে আইএমএফ-এর আমলাতন্ত্র খুশি, আমরাও খুশি। তিনি বলেন, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশের বেশি উল্লেখ করে বেসরকারি খাতে শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। কিন্তু শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারি ব্যয়ের বিকল্প নেই, বেসরকারি খাত থাকবে পরিপূরক হিসাবে। শিক্ষায় সরকারি ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা এখন সমান।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানির চাপ বাড়ায় রিজার্ভ কমছে। এখনো এলসি খোলায় সমস্যা হচ্ছে। ৬ মাস ধরে ডলার সংকট চলছে। আমদানি বিল পরিশোধ সময়মতো করা যাচ্ছে না। ফলে দেনা বাড়ছে। তবে আইএমএফ-এর ঋণ বড় কিছু না হলেও অন্যদের কাছ থেকে ঋণ পেতে সহায়ক হবে। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সামষ্টিক খাতে যে শক এসেছে তা বাস্তবতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুষ্টি কম পাচ্ছে মানুষ। জীবনমানের অনেক কিছুর সঙ্গেই আপস করতে হচ্ছে। কোভিডে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা অনেক বড় ক্ষতি। দুই বছরের ক্ষতি প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। জাহিদ হোসেন বলেন, আইএমএফ-এর ঋণের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। অন্য সূত্র থেকেও ঋণ পেতে হবে। আর্থিক খাতে সংস্কারে সাহসী ভূমিকা নিতে হবে। আসলে সরকার চালাচ্ছে কে? এটিই এখন বড় প্রশ্ন। রাজনীতিবিদরা না আমলাতন্ত্র। সংসদের মধ্যেও অনেক সংসদ-সদস্যকে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আসলে রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। মোস্তাজিুর রহমান বলেন, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতের পাশাপাশি ওষুধ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংসহ অন্য খাতের দিকে যেতে হবে। দিনের অন্য অধিবেশনগুলোয় বক্তব্য দেন ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফা কে. মুজেরী, বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ড. মঞ্জুর হোসেন, সানেমের গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা প্রমুখ। আজ বিভিন্ন অধিবেশনে আরও প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে।