আইএমএফ’র দৃষ্টিতে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
উচ্চ খেলাপি ঋণ প্রবৃদ্ধির গতি বাধাগ্রস্ত করবে
দেলোয়ার হুসেন
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করবে। খেলাপির নেতিবাচক প্রভাবে কমে যাবে প্রবৃদ্ধির গতি।
এর গতি বাড়াতে ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়ে কঠোর শর্ত আরোপ করেছে সংস্থাটি। তারা বলেছে, দ্রুত আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে এবং বাড়াতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি। একই সঙ্গে আইনি কাঠামোতে বড় সংস্কার আনতে হবে।
বৃহস্পতিবার রাতে আইএমএফ’র ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে।
ঋণের শর্ত ও দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এগুলো মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কেও বিস্তারিত বলা হয়েছে। ১২৫ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত সংস্কার হলে মন্দা মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি চলতি অর্থবছর থেকেই ঘুরে দাঁড়াবে।
এখন থেকে আগামী দেড় বছর পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আবার ৭ শতাংশের বৃত্তে প্রবেশ করতে পারবে। পরপর তিন বছর ৭ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির হার কমে আসবে। তবে চলতি অর্থবছরে গড়ে এ হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। অর্থবছর শেষে এ হার ৮ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে। অর্থনৈতিক অন্যান্য সূচকগুলোতেও আগামী অর্থবছর থেকে ইতিবাচক ধারার আলো পড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে। আগামী অর্থবছরে এ হার ১ শতাংশ বেড়ে সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। এরপর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের বৃত্তে ফিরে যাবে। ২০২৬-২৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশের ঘরে পৌঁছবে।
প্রতিবেদনে এ সাফল্য অর্জন করতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংস্কার বাস্তবায়ন থেকে সরকারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। যদি এটি হয় তবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারা ফিরে আসবে না।
একই সঙ্গে সংস্থাটির ঋণের সুফল মিলবে না। এছাড়া খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে শনাক্ত করেছে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সংস্থাটি অন্যতম বাধা হিসাবে চিহ্নিত করেছে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিকে। আর্থিক খাতকে গতিশীল ধারায় ফিরিয়ে আনতে কঠোর শর্ত আরোপ করেছে।
তারা বলেছে, জুনের মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নবায়ন ও খেলাপি ঋণের তথ্য বার্ষিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে প্রকাশ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তথ্য প্রকাশ করতে হবে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতের মূলধন বাড়ানো, ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ কমানো এবং খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখার হার বাড়াতে হবে। একই সময়ের মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তদারকির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
সূত্র জানায়, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে এক লাখ কোটি টাকার বেশি কুঋণে পরিণত হয়েছে। যেগুলোর আদায় সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
প্রকৃত হিসাবে খেলাপি ঋণ আরও বেশি হবে। সেটি আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এর বিপরীতে প্রভিশন হিসাবে রাখা আছে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। সব মিলে প্রায় পৌনে লাখ কোটি টাকার ঋণ আটকে রয়েছে। এগুলোতে কোনো উৎপাদন হচ্ছে না। উলটো ব্যবস্থাপনা করতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ব্যাংকগুলোর। যা অর্থনীতিতে একটি বাড়তি চাপের সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকেও তুলে ধরেছে সংস্থাটি। তারা বলেছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে ধীরগতির কারণে এ সমস্যার প্রতি উন্নয়ন সহযোগীদের মনোযোগ কমিয়ে দেবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি বড় হুমকি। আগের এ হুমকি ছিল।
তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এ হুমকির মাত্রা আরও বেড়েছে। এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্থায়িত্ব বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে পরিবেশ উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উন্নয়ন করতে হবে মানব সম্পদের।
এতে বলা হয়, ভর্তুকি সমন্বয় করতে চলতি অর্থবছরে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়বে। মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে। যা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ভোক্তাদের ভোগের মাত্রা কমিয়ে দেবে।
চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় কম হবে। ফলে সামগ্রিকভাবে বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে দেবে। এ ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে তা সহনীয় মাত্রায় থাকবে। আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় বৈদেশিক মুদ্রার আয় ব্যয়ের ঘাটতি কমবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমে গিয়ে মূল্যস্ফীতির হারও কমতে শুরু করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জিডিপির তুলনায় বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের হার ঝুঁকির মাত্রা নিচে আছে। এ কারণে সামগ্রিক সংকটের কম ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। জিডিপি বাড়ায় এর অনুপাতে ঋণ কমে যাবে। ফলে সামগ্রকি ঋণ জিডিপির হার ৪২ শতাংশের মধ্যে থাকতে পারে। যা অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের চার পাশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। এটি দেশটির অর্থনীতিকেও চাপে ফেলতে পারে। এ জন্য সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ঝুঁকির মাত্রা বাড়বে। এতে দ্রব্যমূল্য যেমন বাড়তে পারে, তেমনি মন্দার আঘাতও আসতে পারে।
মন্দা মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমানোর ফলে আমদানি কমেছে। এতে বড় অর্থনীতির গ্রুপগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে তাদের থেকে নিু পর্যায়ের মানুষের মধ্যে সম্পদের বণ্টন হচ্ছে কম। যা অর্থনীতিতে সমন্বয়হীনতা বাড়িয়েছে। এতে দরিদ্রদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যা টেকসই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অর্জনের জন্য বড় আঘাত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিট রিজার্ভের হিসাব ধরলে এর পরিমাণ অনেক কমে আসে। তখন ওই রিজার্ভ দিয়ে আড়াই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমান হবে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এটি স্থানীয় মুদ্রা জোগানের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে রিজার্ভ পুনর্গঠন করা বা এটি বাড়ানো জরুরি। এক্সেত্রে আইএমএফ’র ঋণ রিজার্ভ পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশ দারিদ্র্য নিরসনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোর টেকসই সমাধান করতে পারেনি। যে কারণে সামান্য ঝাঁকুনিতে অস্থির হয়ে পড়ে। টেকসই উন্নয়নের জন্য মানব সম্পদের উন্নয়ন, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি এবং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।