অর্থ বিভাগের মূল্যায়ন
চ্যালেঞ্জের মুখে অর্থনীতি
রিজার্ভ ও আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব * শিগগিরই আগের অবস্থানে ফেরার প্রত্যাশা
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর ধাক্কায় কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। নেতিবাচক ধারা বইছে আমদানি খাতে। কমেছে সরকারের বাজেটের অর্থ ব্যয়ের অঙ্কও। তবে এ সময় বেশ ভালো অবস্থানে আছে রাজস্ব ও প্রবাসী আয়। যা দেশের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার চালক হিসাবে কাজ করছে।
সার্বিক অর্থনীতিতে করোনা ও যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে অর্থ বিভাগের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। সেখানে আরও বলা হয়, করোনায় এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। পাশাপাশি এ খাতে আছে অস্থিরতাও। তবে সরকারের নানা পদক্ষেপে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু চলমান যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করছে। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রাদুর্ভাব সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে বিগত দিনে যেভাবে আমরা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সাধন করেছি, বর্তমান সংকটও একইভাবে মোকাবিলা করে আমরা সামনে এগিয়ে যাব বলে আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি।’
সার্বিক বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, আমদানি ব্যয় আগের তুলনায় পর্যায়ক্রমে কমছে। পাশাপাশি রপ্তানি ও প্রবাস আয়ও বাড়ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ ধীরে ধীরে কমে আসবে। এছাড়া বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারে সেজন্য ৪৩ ধরনের পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে প্রচলিত বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অতিরিক্ত এক শতাংশ হারে প্রণোদনা অন্যতম। সব মিলে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ কেটে যাবে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এই অনিশ্চয়তা কবে কাটবে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে নানাভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের বাইরে যেতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ঠিক থাকবে কিনা-সেটিও নিশ্চিত নয়। ফলে আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়ে থাকতে হবে। খুব শিগগির তা কাটবে।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। তবে কোভিড-১৯ শুরুর আগে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ছিল দেশের অর্থনীতিতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। কিন্তু করোনার নেতিবাচক প্রভাবে সাময়িক হলেও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হয়। পরবর্তীকালে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পর ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ অর্জন হয়। কিন্তু চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, গম, ভোগ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। বেড়ে যায় বিশ্ববাজারে পরিবহণ ব্যয়ও।
বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশের অর্থব্যয়ের চিত্রও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট অর্থ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে ব্যয় হয়েছে ৭৫ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। এটি মোট ব্যয়ের ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ সময় সরকারের ব্যয়ও কিছুটা কমছে। এই ব্যয় করতে প্রথম প্রান্তিকে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ না নিয়ে উলটো ৯ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এদিকে আমদানি ব্যয় ঋণাত্মক উল্লেখ করে বলা হয়, অর্থবছরের তিন মাসে আমদানি খাতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি (২০.৯০ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। এটি বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। অর্থ বিভাগের মূল্যায়নে আরও বলা হয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে কিছুটা চ্যালেঞ্জ বিরাজমান থাকলেও রাজস্ব আদায়ের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১১ শতাংশ। এ সময় আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এর কারণ হিসাবে বলা হয়, সামগ্রিকভাবে মূসক আদায়ে ইএফডি মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধির উদ্যোগ, আয়কর সেবা গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসাবে গ্রুপ অব রিটার্ন সাবমিশন বাধ্যতামূলক, রিটার্ন ফরম সহজীকরণসহ নানা উদ্যোগের কারণে এই রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
এদিকে গত জুলাই-ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স আসছে ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স বেড়েছে ২৫ কোটি ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার। অর্থ বিভাগের মূল্যায়নে বলা হয়, প্রবাস আয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রদান, হুন্ডিসহ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো নিরুৎসাহিত এবং মোবাইল ফ্যাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স গ্রহণ অনুমোদন দেওয়া হয়। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে এ খাতে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি হয়। এছাড়া সেপ্টেম্বরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা মূল্য দাঁড়ায় ৯৫ দশমিক ৬ টাকা। এ সময় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ১১ দশমিক ৮১ শতাংশ। যে কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। তবে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য অপ্রয়োজনীয়, বিলাস পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত রিজার্ভ আগের শক্ত অবস্থানে ফিরে যাবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা দেশের অর্থনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে।