Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ট্রাক-ভ্যানের পেটে মেয়র আনিসুল হক সড়ক

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ট্রাক-ভ্যানের পেটে মেয়র আনিসুল হক সড়ক

ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের দখলে রাজধানীর সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন সড়ক। বুধবারের ছবি -যুগান্তর

রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের একটি ‘তেজগাঁও সাতরাস্তা-রেলগেট’ সড়ক। কিন্তু সেটি এখন পুরোপুরি ট্রাক-ভ্যানের দখলে।

যেন সড়কটিই গিলে খেয়েছে সারি সারি ট্রাক আর ভ্যান। রাতদিন একইচিত্র থাকলেও যাদের দেখার কথা-তাদের চোখে যেন তা পড়েই না। নেওয়া হয় না কোনো ব্যবস্থাও।

তিন দিন সড়কটি ঘুরে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি অফিস, ঐতিহ্যের কাওরান বাজার, রেলওয়ে স্টেশন ও অন্তত ৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা এ সড়কের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু শতফুটের ওই সড়কে এখন দুটি রিকশাও পাশাপাশি চলতে পারে না। দুপাশে ফুটপাত পর্যন্ত দখলে চলে যাওয়ায় কোথাও কোথাও হাঁটাও সম্ভব নয়। সড়কটির মধ্যভাগের দক্ষিণপাশে একটি গণশৌচাগার রয়েছে। দখলি ট্রাকের কারণে তা চোখেই পড়েনি।

ট্রাকচালক, সড়ক পরিবহণ নেতা, সাধারণ পথচারী, শিক্ষার্থী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, এ সড়কটি ২০১৫ সালের আগে আরও করুণ অবস্থায় ছিল। দখলের এমন মহোৎসব ছিল যে, এ সড়কে হাঁটাই সম্ভব ছিল না। উত্তর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক বহু বাধা, বিক্ষোভ ও হুমকি উপেক্ষা করে, সরকারি-বেসরকারি-ব্যক্তিগত সব শক্তি কাজে লাগিয়ে সড়কটি দখলমুক্ত করেন। সড়কটি সংস্কার করে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেন, বসান সারি সারি আলোকবাতি। সে সড়কবাতির অনেকগুলোই এখনো জ্বলে, আর ফলকে ‘মেয়র আনিসুল হক সড়ক’ লেখা থাকলেও সড়কটিই এখন যেন অদৃশ্য।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রাক ঘিরে চলে মাদক সেবন, ট্রাকের ভেতর, নিচে, ওপরে বসে জুয়ার আসর। নারী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ নারী পথচারীরাও নানা সময় যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হচ্ছেন। এক শিক্ষার্থীর মা আফরোজা খাতুন বলেন, এ সড়ক হয়ে কোনো সুস্থ মানুষ হেঁটে যেতে পারবে না। আমরা বাধ্য হয়ে যাই। মেয়ে বড় হয়েছে, মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় যেমন ট্রাক ড্রাইভার-হেলপার, কর্মচারীদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখতে হয়, আসার সময়ও তাই। ফুটপাত দখল থাকায় মাঝপথ ধরেই হাঁটতে হয়। ফুটপাত বেয়ে আসা মলমূত্র রাস্তার মধ্যভাগ পর্যন্ত ঠেকে, কিন্তু কেউই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সাতরাস্তা থেকে-তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত সড়কে হেঁটে দেখা যায়, রাস্তার দুপাশে দেড় শতাধিক বড় ট্রাক পড়ে আছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে ছোট কাভার্ড ভ্যানের সারি। শৌচাগারে কর্মরত এক শ্রমিক জানান, এসব ট্রাক ঘিরে মাদকের আসর বসে। রাত বা দিন, মাদক বিক্রেতা-সেবনকারী আর প্রতিরোধী সংস্থার সদস্যরা একে অপরের হয়ে কাজ করে। আনাগোনা থাকে ভাসমান পতিতাদের।

রেলগেটের দক্ষিণ পাশেও সারি সারি রাখা রয়েছে ট্রাক ও ভ্যান। ফল বিক্রেতা হিরণ মিয়া বলেন, ‘ওই রাস্তা (সাতরাস্তা থেকে রেলগেট পর্যন্ত) দখল হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। নতুন করে রেললাইনের পাশে থাকা উত্তর ও দক্ষিণ পাশের রাস্তাও দখলে চলে গেছে। চাঁদা দেওয়া ছাড়া এখানে ট্রাক বা ভ্যান রাখা যায় না। আমি নিজেও চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করি।’

ট্রাকচালক রাসেল মিয়ার ভাষ্য, ‘তেজগাঁও স্ট্যান্ড ট্রাকে ভরা। রাস্তায় থাকা সব ট্রাকই এখানকার প্রভাবশালী মালিকদের। এরা রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী। আমরা ট্রাকের ভেতরই থাকি। কল এলেই ট্রাক বের করি। বাহিরের ট্রাক রাস্তায় রাখা হলেই প্রতিদিন ৫শ টাকা করে চাঁদা গুনতে হয়। রাজধানীর বাহির থেকে আসা ট্রাকও রাস্তায় রাখা হয়।’ দেখা গেছে, অনেক ট্রাকের নিচে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। হেলেনা বেগম নামের এক পরিচ্ছন্নকর্মী বলেন, ‘এ রাস্তা পরিষ্কার করার জায়গা পাই না। ট্রাক আর ট্রাক, পরিষ্কার করব কই। আমরা বাধ্য হয়ে, কিছু জায়গায় ঝাড়ু ছুঁয়াই। স্যার (আনিসুল হক) থাকলে, এ সড়কের অবস্থা এমন হতো না।’

সড়কটি সাতরাস্তা হয়ে কাওরান বাজার, তেজতুরী বাজার, ফার্মগেট ও তেজগাঁও, মহাখালী, বনানী, গুলশান, নিকেতন, হাতিরঝিল এবং রামপুরার সঙ্গে যুক্ত। ফার্মগেট-তেজগাঁও ঘিরে এক ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া এ সড়ক হয়ে জাতীয় নাক-কান-গলা ইনস্টিটিউট, সংবাদপত্র ভবন, ছাপাখানা, প্রধান কার্যালয়সহ বহু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং সাধারণ মানুষ এ সড়ক ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন বাধ্য হয়েই অনেকে এ পথ ছেড়েছেন।

তেজগাঁও শিল্প এলাকার বাসিন্দা ব্যাংকার জুলফিকার আহসান জানান, মেয়র আনিসুল হক যেমন এ সড়ক দখলমুক্ত করেছিলেন, তখন এ সড়ক হয়ে বিভিন্ন যানে মানুষ খুব সহজে চলাচল করতে পারত। মেয়রের মৃত্যুর পরপরই সড়কটি দখলবাজ সন্ত্রাসীদের দখলে চলে যায়। রেলগট থেকে সাতরাস্তার দিকে যেতে ২০০ ফুট দূরেই স্মৃতিফলকে লেখা ‘মেয়র আনিসুল হক সড়ক’। ট্রাকের ধাক্কায় সেটির অবস্থাও সঙ্গীন। সেখানে দাঁড়িয়ে কথা হয় পথচারী বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই তেজগাঁও স্ট্যান্ড জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যাই। কিন্তু এ সড়ক দিয়ে হাঁটাও কষ্টকর। বর্তমান মেয়র কেন উদ্যোগ নিচ্ছে না জানি না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

মঙ্গলবার দুপুরে এ সড়কের মধ্যস্থলে দুই রিকশাচালক তর্ক করছিল। কারণ একে অপরকে পাশ দিতে গিয়ে উভয় রিকশা আটকে যায় দুপাশে রাখা ট্রাকের সঙ্গে। রিকশাচালক কালামের ভাষ্য, এত বড় সড়কে সমানতালে দুটি রিকশাও চলতে পারে না। ছোট ভ্যান সড়ক ধরে চললে রিকশার সঙ্গে জট বাঁধে। ওই সময় এক কিলোমিটারের কম এ সড়ক অতিক্রম করতে সময় লেগে যায় ৩০ থেকে ১ ঘণ্টা।

বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি মো. মনির হোসেন তালুকদার যুগান্তরকে বলেন, ‘এখানে শক্তির খেলা চলে। উচ্ছেদের সময় কোনো কোনো নেতা উচ্ছেদকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আমরা চাই, একটা সমাধান। প্রয়াত মেয়র যে সুন্দর সড়কটি করে গেছেন, তা ধরে রাখা যাচ্ছে না। আমরা চাঁদা নেই না। আমাদের ট্রাক স্ট্যান্ডে থাকে, সড়কে থাকে না। এসব ট্রাক বাহির থেকে আসা। আমাদের জায়গা দেওয়া হলে, স্ট্যান্ড করে রাস্তায় থাকা ট্রাক-ভ্যানগুলো সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি হাজী তোফাজ্জল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নিরুপায় হয়েই এখানে ট্রাক রাখছি। আমরা চাই টিঅ্যান্ডটিতে খালি জায়গা আছে, সেখানে ট্রাকস্ট্যান্ড করে রাস্তার ট্রাক স্থানান্তর করা হোক। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার ট্রাক আসা-যাওয়া করে। রাস্তাটি পুরোপুরি দখলে চলে গেছে। এজন্য লোড ট্রাক স্ট্যান্ডে ঢুকতে বের হতেও সমস্যায় পড়তে হয়।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে বলেন, আমরা মোবাইল কোর্ট করি, জরিমানা করি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। আমরা জায়গা খুঁজছি, ট্রাকস্ট্যান্ড তৈরি করা হবে। একই সঙ্গে এ সড়ক দখলমুক্ত করতে যা যা প্রয়োজন তা করা হবে। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এডিশনাল পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক (প্রধান) মো. মনিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, সড়কটি দখলমুক্ত করা জরুরি। এজন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। এজন্য সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতাও চাচ্ছি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম