প্রতীকী ছবি
ঋণের অন্তরালে প্রায় ১৩৩ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) থেকে। অস্তিত্বহীন ব্যবসা, জামানতের অতিমূল্যায়ন ও ভুঁয়া সমঝোতা পত্র দাখিলসহ নানা কৌশলে বিপুল অঙ্কের অর্থ হজম করা হয়। পৃথক ১৪টি ঋণের মাধ্যমে টাকা নিলেও আর ফেরত পায়নি ব্যাংক। সব ঋণই এখন খেলাপি।
ঋণগুলো ইস্যু করা হয়েছিল ব্যাংক কোম্পানি আইন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডির সার্কুলার ও ঋণ নীতি লঙ্ঘন করে। সরকারের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসছে ঋণ নিয়ে নয়ছয়ের ঘটনা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এসব ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আলমগীরে মতে এসব ঘটনা তার সময়ে ঘটেনি, অনেক আগের ঘটনা। তিনি বলেন, নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা ঋণগুলোর অধিকাংশই রাইট অব করা হয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলো থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করছি। পাশাপাশি নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে।
নীতিমালার বাইরে গিয়ে ঋণ ইস্যুর ক্ষমতা কোনো ব্যাংকের নেই। কিন্তু মাঠপর্যায়ে ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণ দেওয়ার আগে জামানত ও ব্যক্তি সম্পর্কে সঠিক যাচাই-বাছাই না করে অনেক ঋণ ইস্যু করেন। সেখানেই বিপত্তি ঘটছে বলে মনে করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাণিজ্যিক অডিট, অভ্যন্তরীণ ও বহিঃনিরীক্ষা) মো. হারুন অর রশিদ মোল্লা। তিনি বলেন, সিএজি অফিস থেকে অডিট আপত্তি নিয়ে জবাব চাইলে আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকি। ব্যাংকগুলো ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের জবাব দিলে সেটি সিএজি অফিসে পাঠানো হয়। কিন্তু সংসদীয় হিসাব কমিটিতে যেসব অডিট রিপোর্ট উত্থাপন হয় সেগুলোর ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
জানা গেছে, বিডিবিএলসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে জুন পর্যন্ত বিডিবিএল’র মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৭৬৮ কোটি টাকা দেখানো হয়। ওই বৈঠকে ঋণ আদায়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিডিবিএল’র ১৪টি ঋণের ঘটনা তুলে ধরা হয় নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ঋণের বিপরীতে সহ-জামানতের অঙ্কে ঘাটতি পাওয়া গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামানত অতি মূল্যায়ন করে ঋণ মঞ্জুরসহ অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে বিধিবহির্ভূত ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ঋণ অনুমোদন ও বিতরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শাখা ব্যবস্থাপক ক্ষমতা বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, খুলনা শাখা থেকে ৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে প্রকল্প চালু করতে পারেনি ক্রিসেন্ট রাইস মিল। খেলাপির পর ঋণটি অবলোপনের জন্য ২০২০ সালে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন করা হয়। সেখানে ঋণের বিপরীতে জামানতের ওই বছরের বাজার মূল্য বের করে দেখা গেছে ৪ কোটি ৮১ হাজার টাকা। অথচ ২০১১ সালে ঋণ প্রস্তাবে একই জামানতের মূল্য দেখানো হয় ৮ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দীর্ঘ ৮ বছর পর জামানত মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু সেটি না হয়ে জামানতের মূল্য কমেছে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, এতেই প্রতীয়মান গ্রাহকের সহ-জামানত সম্পত্তি অতি মূল্যায়নের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান ঋণ ও আসল মিলে প্রায় ১৩ কোটিতে উঠেছে। অপরদিকে ঋণের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
জমির মূল্য কমানোর পেছনে আম্পান ও করোনাকে উল্লেখ করে জবাব দিয়েছে গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু নিরীক্ষা দল দেখতে পায় একই শাখায় অন্য কয়েকটি ঋণে সহ-জামানত সম্পত্তি দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মূল্য বেশি। সেখানে কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এলাকার উন্নয়নের ফলে জমির বাজার মূল্য ব্যাপক হারে বেড়েছে।
অপর ঘটনায় ঋণের টাকা দিয়ে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনার শর্তে পৌনে ৩ কোটি টাকা দেওয়া হয় রাজশাহীর শাখার গ্রাহক গাজী রাইস মিল ও করিম এন্টারপ্রাইজকে। কিন্তু যন্ত্রপাতি না কিনেই ঋণের টাকা তুলে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিদর্শন না করেই দেওয়া হয় ঋণ। বর্তমান এই ঋণ ও সুদ মিলে সাড়ে ৪ কোটিতে উঠেছে।
এছাড়া ঢাকা ট্রেডিং হাউজকে প্রিন্সিপাল অফিস থেকে ১৫ শতাংশ মার্জিনে ৩০ কোটি টাকার লোকাল এলসি লিমিটেডের বিপরীতে ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার এলটিআর (লোনের বিপরীতে ট্রাস্ট রিসিপ্ট) সুবিধা দেওয়া হয়। একইভাবে প্রধান কার্যালয় ১০ শতাংশ মার্জিনে ২৫ কোটি টাকার রিভলভিং সীমার বিপরীতে ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এলটিআর সুবিধা দেওয়া হয়। দুটি এলটিআরের বিপরীতে ৪৮ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় গ্রাহককে। এটি ৯০ দিনের মধ্যে পরিশোধযোগ্য। কিন্তু দেখা গেছে, এলটিআরের বিপরীতে পণ্য বিক্রি করে দিলেও গ্রাহক ব্যাংকের টাকা শোধ করেননি। পরে গ্রাহকের ঋণ মঞ্জুরের ডকুমেন্টের সত্যতা যাচাই করতে জি কিবরিয়া অ্যান্ড কো. নামে একটি সিএ ফার্ম নিয়োগ দেয়। ওই ফার্মের রিপোর্টে দেখা গেছে গ্রাহক এলটিআরের জন্য দুর্যোগ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ডাইরেক্টর জেনারেল (ফুড) এবং মেসার্স ঢাকা ট্রেডিংয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর (এমওইউ) পত্র জমা দিয়েছিলেন। যা ছিল ভুয়া।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ্য, প্রিন্সিপাল অফিস থেকে টাটকা এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ ঋণ নিয়েছে ৫০ কোটি টাকা। জামানতের মূল্য ২৪ কোটি টাকা। সহ-জামানত থেকে ঋণ ২৬ কোটি টাকা বেশি। এই ঋণ নেওয়ার পরও খাতওয়ারী ব্যয় করা হয়নি। বর্তমান প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ অবস্থা আছে।
আরও দেখা গেছে, রাজধানীর কাওরান বাজার শাখার মাহসালিম ইস্পাত প্রা. লি., বগুড়ার মেসার্স সরকার ব্রাদার্স ফ্লাওয়ার অ্যান্ড ওয়েল মিলস, খুলনার লামিয়া অটো কোকোনাট অয়েল মিল, আশুগঞ্জের মেসার্স অনিকা বয়লার অ্যান্ড অটো রাইস মিলস ঋণের নামে বিডিবিএল থেকে আলাদা নামে ২৮ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে।
এসব ঘটনার ব্যাপারে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ, সরকারির অর্থ আদায় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিধিবিধান পালনের সুপারিশ করা হয়েছে।