Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

প্রকল্প থেকে ‘মানব ঘুস’

Icon

হামিদ-উজ-জামান

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকল্প থেকে ‘মানব ঘুস’

এতদিন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে গাড়ি নেওয়া বা বিদেশ সফরের সুযোগ গ্রহণের বিষয় ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন প্রসঙ্গ। এবার নানা অজুহাতে প্রকল্প থেকে ‘মানুষ ঘুস’ নেওয়া হচ্ছে। ঊর্ধ্বতনকে খুশি রাখতে প্রকল্প থেকে মানুষ জোগান দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট পরিচালক। অনেক সময় প্রকল্প পরিচালককে চাপ দিয়েও এ ধরনের লোক নেওয়া হয়। এসব কর্মচারী সরকারের রাজস্ব বিভাগের নন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্প কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার স্থায়ী কর্মচারীও নন। অস্থায়ীভাবে কাজ করেন-এমন লোকই ঘুস হিসাবে দেওয়া হচ্ছে। তারা দিনের পর দিন কাজ করছেন পরিকল্পনা কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সংস্থায়। তারা বেতনভাতা নেন প্রকল্প থেকেই। এক প্রকল্প শেষ হলেও যুক্ত হন অন্যটিতে। এভাবে দীর্ঘদিন কাজ অব্যাহত রেখেছেন বহিরাগত ৫৬ কর্মচারী। তারা ভৌত অবকাঠামো, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান এবং আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে কাজ করছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

অভিযোগ আছে-এ ধরনের কিছু কর্মচারীর সহায়তায় নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। আবার বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকদের সঙ্গে তদবিরসহ কর্মকর্তাদের পক্ষে দেনদরবারে যুক্ত থাকেন তাদের কেউ কেউ-এমন নজিরও আছে। শুধু তাই নয়, ঠিকাদারদের সঙ্গেও থাকে তাদের যোগসাজশ। অনেক সময় অসাধুরা অবৈধ লেনদেনও করে থাকেন তাদের দিয়ে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থা থেকে গোপন তথ্য পাচারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি সবার অগোচরে ঘটলেও জনবল সংকটসহ নানা অজুহাতে জায়েজ করা হচ্ছে, কেউ কিছু বলছেন না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, এটা খুব খারাপ বিষয়। এ বিষয়টি আমার জানার মধ্যে ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে দেখব আসলে বিষয়টি কী। এর বেশি কিছু এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, জনবল সংকট থাকলে সেটি পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু তাই বলে বহিরাগত লোকবল দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাটা কতটুকু যৌক্তিক। এটা একধরনের ‘মানুষ ঘুস’ নেওয়ার মতো অবস্থা।

সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের সবচেয়ে বেশি প্রকল্প আসে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ থেকে। এই তিন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগেই কাজ করেন বহিরাগত প্রায় ৫৬ জন কর্মচারী। তারা সবাই অফিস সহকারী, অফিস সহায়ক কিংবা কম্পিউটার অপারেটর পদে কাজ করেন। ভৌত অবকাঠামো বিভাগে এমন আছেন ১৫ জন, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগে ২৯ জন এবং আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে আছেন ১২ জন। এ পর্যায়ে কর্মচারীরা যেসব কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেন তারাই সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলোর প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে মূল ভূমিকায় থাকেন। তারা কাজ করেন মূলত প্রধান, যুগ্মপ্রধান, উপপ্রধান এবং সিনিয়র সহকারী প্রধান পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসাবে।

কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সহকারী প্রধান পর্যায়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। যিনি নিজেও এ রকম প্রকল্প থেকে জনবল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এটা প্রথমত অনৈতিক। দ্বিতীয়ত, সরকারি কোনো বিধিবিধান কিংবা পরিকল্পনা কমিশনের অর্গানোগ্রামের মধ্যে পড়ে না। কারণ এমন জনবলের কথা কোথাও বলা নেই। কিন্তু আমাদের জনবলের এত সংকট যে বাধ্য হয়েই প্রকল্প থেকে লোক নিতে হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এই লোকগুলো খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে এবং তারা সব সময় যথাযথ দায়িত্ব পালন করে বলে তাদের আর বাদ দেওয়া হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে এদের মাধ্যমে কোনো অনৈতিক সুবিধা নিইনি। তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচারের আশঙ্কার বিষয়টি সঠিক। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের স্থায়ী কিছু কর্মচারী আছেন যারা এদের কারণে অনৈতিক কাজের সুযোগ পান না। ফলে তারা সব সময় এই জনবলের পেছনে লেগে থাকেন। তবে এসব বিষয়ে প্রশ্ন ওঠায় এর আগে একবার ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য (সচিব) শামীমা নার্গিস এসব কর্মচারী সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় সেটি পারেননি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এমন কাজ অনৈতিক, অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। আইনে কোনো নিয়ম না থাকলেও এভাবে মৌখিক ভিত্তিতে প্রকল্প বা সংস্থা থেকে জনবল নিয়ে কাজ করানোটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এতে এক ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যে সংস্থা প্রকল্প অনুমোদন, সংশোধনসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ করে, সেখানেই যদি প্রকল্পেরই লোক কাজ করে তাহলে প্রশ্ন তৈরি হয়। এতে পরিকল্পনা কমিশন তার নিরপেক্ষ ভূমিকা কতটুকু পালন করতে পারবে। সেই সঙ্গে যেসব প্রকল্প থেকে জনবল উঠিয়ে আনা হয়েছে, সেখানে জনবল অনুমোদনের ক্ষেত্রে ত্রুটি ছিল। কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পে নিয়োগ পেয়েছিলেন মো. ওয়াদুদ হোসেন। সেখান থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এরপর থেকে প্রায় ১৬ বছর এখানেই কাজ করছেন তিনি। কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে এখনো কাজ করছেন এই কর্মচারী। অথচ শেষ হয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প। মাঝে বেশ কিছুদিন কাজ করেছে বিনা টাকায়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প অনুমোদন পেলে সেখানে তাকে যুক্ত করা হয়। একই অবস্থা মো. নুরে আলমেরও। থ্রি ব্রিজ প্রকল্প দিয়ে ওই যে কাজ শুরু হয়, পরিকল্পননা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে এখনো অব্যাহত আছে। জানতে চাইলে মো. ওয়াদুদ বলেন, আমি অনেক দক্ষতার সঙ্গে কাজ করি। প্রকল্প শেষ হলেও ভালো কাজ করায় স্যাররা ছাড়তে চান না। ফলে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নই। প্রায় একই মন্তব্য করেন নুরে আলমও।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগে কাজ করেন সুপ্রিয়া সরকার, রুমান ইসলাম নাইম, মো. মাসুদ, শেখ মো. জালাল উদ্দিন, শাহানা খাতুন, শিরিন সুলতানা, নাসরিন আক্তার, জিয়াসমিন আক্তার, রাশিদুল হক ও ইব্রাহিম। আরও আছেন জহিরুল ইসলাম, ওমর ফারুক ও সালমা রনি।

একজন প্রকল্প পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এটা একধরনের অনিয়ম হলেও আমাদের করতে হয়। এছাড়া এটা সরকারি অর্থের কোনো অপচয় নয়। কেননা ওই কর্মচারী সরকারি কাজই করছেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করেন বলেই আমরা আউটসোর্সিংয়ের জনবল হিসাবে দিয়েছি। সেখানে আমাদের লোক থাকলেও ভালো হয়। বোঝেনই তো আমাদেরও নানা কাজকর্ম থাকে।

কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লি প্রতিষ্ঠান বিভাগে আছেন সুদ্বিপতা, শাহাদত হোসেন, মিজান, সাইফুল ইসলাম, জয় হোসেন ও রিয়াদ। এছাড়াও আছেন আরিফুল ইসলাম, হাবিব, মাজেদা খাতুন, আমিনুল এহসান, দেবব্রত, মারুফ, রাজিব, সাঈদ, রাহেলা খাতুন, মুজাহিদ হোসেন এবং পাপিয়া সুলতানা। আরও কাজ করছেন ইমা, জরিনা, ইফফাত আক্তার, আনোয়ারা বেগম, শহিদ, শওকত, ওয়াহিদ ইসলাম, মাহবুবুল ইসলাম, গুলশান আরা, ফরিদ, শাহ আলম এবং নুরুল হক। আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগে আছেন শাহিন আলম, আসাদুজ্জামান, আন্না ইসলাম, সবুজ মিয়া, সালমা সুলতানা, রুবি আক্তার এবং জামাল হোসেন। এছাড়াও আছেন রেজিয়া পারভীন, নুরুল আলম, মাহফুজুল ইসলাম, সেলিম ও ইলিয়াছ উদ্দিন।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য ও বর্তমান পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। একজন লোক নিয়োগ দিতে গেলে বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এজন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন। সেসময় পর্যন্ত কি কাজকর্ম বন্ধ থাকবে। কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য এসব লোক নেওয়া হয়। এটা কোনো ‘ঘুস’ নয়। তবে তারা যাতে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করতে না পারে, সে বিষয়টি দেখা হবে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রায় আট বছর আগে প্রকল্প থেকে ভৌত অবকাঠামো বিভাগে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল মানিক চন্দ্রবর্ম্মন নামের একজন অফিস সহকারীকে। দীর্ঘ ৬ বছর কাজ করেছেন তিনি। এ সময় ঠিকাদারদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লেনদেনের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই বছর আগে তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মানিক চন্দ্র বর্ম্মন যুগান্তরকে বলেন, এটা ছোট্ট একটা বিষয় ছিল, যার কারণে আমাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে আমি কোনো প্রকল্পের লোক ছিলাম না। বিশেষ সিস্টেমে পরিকল্পনা কমিশনের কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এখন যেহেতু সেখানে নেই, এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলতে চাই না।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত) ড. ফরিদ উদ্দিন আহমদ মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, জনবল ঘাটতি থাকলে এটা করা যায়। প্রকল্প থেকে ডেপুটেশনে লোক এনে কাজ করানোটা অপরাধ নয়। এটা সব মন্ত্রণালয়ই করে থাকে। তবে যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিংবা প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত করে লোক নিয়ে আসা হয় তাহলে সেটি অনৈতিক।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম