দিল্লিতে শেখ হাসিনার নির্বাসিত জীবন
স্বস্তির সুবাতাস ছিল পান্ডারা পার্কে
আবদুল্লাহ আল মামুন, নয়াদিল্লি থেকে ফিরে
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘খুনিরা আমাদেরকেও খুঁজছিল। আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল তারা। ভারতের পান্ডারা রোডে আমরা যখন ছিলাম, সেখানে আমাদের নামও বদলে ফেলা হয়েছিল। এটা খুবই কষ্টের যে, আমরা নিজের নাম, নিজের পরিচয় ব্যবহার করতে পারছিলাম না। নিরাপত্তার কারণেই সেটা করতে হয়েছিল।’
এ মাসের শুরুতে ভারতীয় গণমাধ্যম এএনআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিল্লিতে পান্ডারা রোডের ফ্ল্যাটে গোপন নির্বাসন জীবনের স্মৃতিচারণ এভাবে করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর প্রতিকূল সময় ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত পান্ডারা রোডে থাকতে হয়েছিল তাকে।
এই প্রতিবেদক ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ঐতিহাসিক পান্ডারা রোডের সেই বাড়িটি (DII-16,
PANDARA ROAD, NEW DELHI, INDIA) খুঁজে বের করেন। এ নিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে ‘দিল্লিতে শেখ হাসিনার নির্বাসন জীবন; স্মৃতিময় পান্ডারা রোডের সেই বাড়ি’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঐতিহাসিক ওই বাড়ির সামনে ছিল একটি খেলার পার্ক, যা আজও আছে। এই পার্কটিই হচ্ছে পান্ডারা পার্ক।
বাড়ির সামনের পার্কটিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সবুজ ঘাসে মোড়ানো পার্কটিতে শিশুদের খেলার জন্য কয়েকটি রাইড রয়েছে। তবে শিশুদের পদচারণায় পার্কের কিছু জায়গার ঘাস উঠে মাটি বের হয়ে আছে। পার্কে দেখা গেছে, বড়দের শরীরচর্চার কয়েকটি যন্ত্রপাতিও। এছাড়া বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রয়েছে লোহার বেঞ্চ। পার্কের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় গাছ।
ফ্ল্যাটে বসবাসের সময় কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়েছিল শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের। বঙ্গবন্ধুর জামাতা, বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া তার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে পান্ডারা রোডের বাসায় থাকার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-‘বাইরের কারও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া, কারও সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ না করা এবং নিরাপত্তা প্রহরী ব্যতিরেকে বাইরে না যাওয়া অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে আমাদের সবাইকে স্মরণ রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়।’ দিল্লির প্রবীণ সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী যুগান্তরকে বলেন, ফ্ল্যাটে পরিচয় গোপন করে সতর্কতার সঙ্গে বসবাসের সময় শেখ হাসিনা মাঝে মাঝে বাড়ির সামনের একটি ছোট পার্কে হাঁটতেন বলে তিনি শুনেছেন। নিরাপত্তার কারণে স্বামী, সন্তান ও ছোট বোনকে নিয়ে অনেকটা আত্মগোপনে থাকলেও ভারতে দীর্ঘ প্রায় ছয় বছরের নির্বাসনকালীন জীবনে একমাত্র স্বস্তির জায়গা ছিল পান্ডারা রোডের পার্কটি। এ সময় প্রতিবেশীদের কাছে সম্ভবত ‘কমলা’ নামে পরিচিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলে জানান দিল্লির এই প্রবীণ সাংবাদিক।
১৯৮১ সালে ভারতে নির্বাসন জীবনের ইতি টেনে দেশে ফিরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই থেকেই শোক দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার পার্কটি নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। শেখ হাসিনা জানান, তিনি ওই পার্কে মাঝে মাঝে হাঁটতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন। এ সময় তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনা তার ছোট বোনকে নিয়ে স্বামী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মস্থল জার্মানি যান।
এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেখানে (দিল্লিতে) আমি দেখা করি মিসেস গান্ধীর (ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী) সঙ্গে। তখন জানতে পারলাম যে, কেউই আর বেঁচে নেই। তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করলেন, আমার স্বামীর (ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া) জন্য চাকরির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে প্রথম ২-৩ বছর অনেক বেশি কষ্ট লেগেছে, কারণ এই ঘটনাটি মেনে নেওয়া খুবই কঠিন ছিল। আমার ছেলের বয়স তখন মাত্র ৪ বছর, মেয়েটা আরও ছোট। তারা নানা-নানির কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করত। বেশি কান্না করত আমার ছোট ভাইটার কাছে যাওয়ার জন্য।’
পান্ডারা রোড এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দিল্লি পুলিশের কর্মকর্তা অজিত মালিক যুগান্তরকে বলেন, এই পার্কে সাধারণত বিকালের দিকে শিশুরা খেলাধুলা করে। তবে খুব সকালে বড়দের কেউ কেউ এখানে শরীরচর্চা করেন।