পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বিব্রত সরকার ও জনগণ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের। শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি-বৃহস্পতিবার তার এমন বক্তব্যে ফের আলোচনায় তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
দেশের রাজনীতিতেও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিএনপির দাবি, মন্ত্রী সরকারের গোমর ফাঁস করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তার এ বক্তব্যকে সমর্থন করে না। তারা জানিয়েছে, এটা দল বা সরকারের বক্তব্য নয়, তার ব্যক্তিগত মত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যুগান্তরকে বলেন, এমন বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেই।
এসব কথা বলে শুধু সরকার নয়, জনগণকেও বিব্রত করেছেন তিনি। তাদের মতে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশের সরকার ঠিক করবে জনগণ।
সরকারকে টিকিয়েও রাখবে জনগণই। এতে অন্য দেশের কিছু করার সুযোগ নেই। বিদেশিদের অনুরোধ দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। এ ধরনের অনুরোধ দেশের জন্য সম্মানজনক তো নয়ই উলটো ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে আরও সতর্কতার সঙ্গে কথা বলা উচিত
দেশের সরকার ঠিক করবে জনগণ: অধ্যাপক ইমতিয়াজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন কথা বলার কোনো মানেই হয় না। রাজনৈতিক বক্তব্য অনেক কিছু হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে কী ধরনের সরকার হবে, তা দেশের স্টেকহোল্ডার, অর্থাৎ দেশের জনগণই ঠিক করেন। এটা বিদেশি কোনো শক্তি কখনই ঠিক করেনি। যদিও অনেক দেশ মাঝেমধ্যেই উৎসাহ দেখাতে চায় যে তারা একটু ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যে যারা স্টেকহোল্ডার আছেন, এর মধ্যে জনগণ একটা বড় কথা। এর মধ্যে মিডিয়া আছে, ব্যবসায়ীমহল আছে, আমলা আছেন-এসব স্টেকহোল্ডারই বাংলাদেশে কী ধরনের সরকার হয় তা ঠিক করেন। এটা ব্যতিক্রম হওয়ার কথা না।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার জন্য অনুরোধ করেছি। তার এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে এসব কথা বলেন।
প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তো সব সময় বিষয়টি বলে এসেছে। এটা জানা দরকার আসলেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি বলেছেন। বিরোধী দল যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা এমনই ছিল। এখন যারা সরকারের আছেন, তখন তারা অন্যরকম কথা বলেছিলেন-এগুলো রাজনৈতিক কথা। আমি মনে করি, দেশের যারা জনগণ, তারাই ঠিক করেন এ দেশে কী ধরনের সরকার হবে।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসলেই কী বলেছেন, তা পুরোপুরি জানা দরকার। কারণ, অনেক সময় কথার আগে আর পরে বাদ দিয়ে মাঝেরটুকু গণমাধ্যমে আসে-এ ধরনের একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। কারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, এটা তার এখতিয়ারের বাইরে, তিনি এভাবে বলতে পারেন না। রাজনৈতিতে অনেক কথাবার্তা বলা হয়, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে তার এভাবে বলার কথা না। সুতরাং তার দিক থেকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।
এমন বক্তব্য যুক্তিযুক্ত ও সম্মানজনক নয়: এম হুমায়ুন কবির
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য সম্মানজনক নয় বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি-পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কথা বলতে পারেন না বলে আমি মনে করি। শুক্রবার যুগান্তরকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘কোনো দেশের সরকার কি অন্যদেশের সরকার গঠন বা পরিবর্তন করতে পারে? সরকার গঠনের জন্য নিজ দেশের জনগণের ওপরই নির্ভর করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, আমি মনে করি এই রকম কথা যুক্তিযুক্ত হয় না। পাশাপশি এমন কথা সম্মানজনকও হয় না।’
এদিকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি, দুই দেশেই কিছু দুষ্টলোক আছে, তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। কিছুদিন আগে তাদের দেশেও এক ভদ্রমহিলা কিছু বলেছেন। সেসময় আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একটি কথাও বলিনি। বিভিন্ন দেশ কথা বলেছে, আমরা একটা শব্দও বলিনি। আমি বলেছি, শেখ হাসিনা আছেন বলেই ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। আর আমাদের উন্নতি হচ্ছে বলে ২৮ লাখ লোক ভারতে বেড়াতে গেছে। প্রায় কয়েক লাখ ভারতীয় লোক আমাদের দেশে কাজ করে। আমাদের এই সোনালি অধ্যায়, আমাদের সুন্দর অবস্থানের কারণেই সম্ভব হয়েছে।’
অনুরোধের বিষয় প্রকাশ্যে বলা ঠিক হয়নি: তৌহিদ হোসেন
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) যদি এমন অনুরোধ করেও থাকেন, সেটা প্রকাশ্যে বলা উচিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি-পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি ভারতকে এসব কথা বলে থাকেন, তাহলে এই ধরনের কথা বলা উচিত হয়নি। আর যদি সেখানে তিনি কথাগুলো বলেও থাকেন, সেটা এখানে এসে পাবলিকলি শেয়ার করা ঠিক হয়নি।’
এ কে আব্দুল মোমেনের এমন খোলামেলা বক্তব্য প্রসঙ্গে শুক্রবার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন যুগান্তরকে এসব কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সবখানেই আলোচনার বিষয় ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে এক আলোচনাসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।’
ওই আলোচনাসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে। শেখ হাসিনা আছেন বলেই ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না।’ মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ নানা ধরনের কথা বলছেন। বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের বক্তব্য।
দায়িত্বশীলদের ভেবেচিন্তে কথা বলা উচিত: আমেনা মহসিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য শুনে আমি বেশ হতভম্ব হয়েছি। আমার মনে হয়, যারা এমন দায়িত্বশীল জায়গায় থাকেন, তারা কী বলছেন-না-বলছেন এবং তা কী ধরনের প্রভাব হতে পরে, সেটা সম্পর্কে একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমরা যখন কথা বলি, তখন দায়িত্ব নিয়ে বলা উচিত। তার বক্তব্য শুধু সরকারকে নয়, সবাইকে বিব্রত করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার তিনি যুগান্তরকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো-বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এরকম একটা দেশে জনগণের সমর্থন নিয়েই রাজনৈতিক সরকার থাকে। সেখানে তার প্রতিবেশী দেশকে কেন টানতে হবে, এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ড. আমেনা মহসিন আরও বলেন, আমরা দায়িত্বশীল কথা না বললে শুধু সরকার নয়, দেশের জনগণও বিব্রত হয়। তিনি বলেন, সেখানে যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় থাকেন। জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় আসেন। সেখানে প্রতিবেশী দেশের সাহায্য নিয়ে সরকার ক্ষমতায় থাকবে-এ ধরনের কথা তো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এসব কথা সরকারের বিপক্ষেই গেছে। কোনোভাবেই এটা তাদের পক্ষে যাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিরোধী দলগুলো এ নিয়ে কী বলছে, আমি সে ব্যাপারে কিছু বলব না। একটাই বলব-তার বক্তব্য সরকারকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে জেএম সেন হলে জন্মাষ্টমী উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার জন্য অনুরোধ করেছি। শেখ হাসিনা আমাদের আদর্শ। তাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে আমাদের দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সত্যিকারের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ হবে।