বিএনপি পুনর্গঠনের হালচাল পর্ব (২)
কাউন্সিল নিয়েও বিতর্ক, পছন্দের লোক নেতৃত্বে

তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণতান্ত্রিক উপায়ে সরাসরি ভোটে জেলাসহ সব পর্যায়ের নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে-বিএনপির হাইকমান্ডের এমন নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এর কারণ হিসাবে নেতারা জানান, যাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তারাই নানা কৌশলে পছন্দের লোককে নেতৃত্বে নিয়ে আসছেন। এ পর্যন্ত সাত সাংগঠনিক জেলা শাখাসহ বেশকিছু ইউনিট কমিটি সরাসরি ভোটে হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক জায়গায় ভোটপদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক উঠেছে।
যে কারণে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের বিষয়টি তৃণমূলে গুরুত্ব হারাচ্ছে। তারা একে কাউন্সিলের নামে ‘তামাশা’ বলছেন।
তৃণমূলের নেতারা অভিযোগ করেন, গঠনতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায়ও কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। একটি পক্ষকে সমর্থন জানিয়ে নিজেদের মতো করে কমিটি গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। আর সেক্ষেত্রে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম তারা ব্যবহার করছেন, যা নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিন দফা সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তনের পর গত ২ এপ্রিল চাঁদপুর জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন হয়। কিন্তু জেলার বিবদমান দুই অংশকে সমন্বয় না করে একতরফাভাবে একটি অংশকে সমর্থন জানিয়েছে কেন্দ্রের একটি পক্ষ।
তাদের যোগসাজশে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা করায় এ জেলায় এখন দুটি কমিটি বিদ্যমান। সম্মেলনকে ঘিরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচন হলেও তা হয়েছে দ্বিধাবিভক্তির। একক নির্বাচন কমিশনের অধীনে এক জায়গায় ভোট হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে চার জায়গায়। ভোটের হিসাবেও তারতম্য ছিল বিস্তর।
এ জেলা সম্মেলনে মোট সাতজন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই একটি অংশের নেতৃত্বে ছিলেন। সম্মেলনে মোট ভোটার (কাউন্সিলর) ১ হাজার ৫১৫ জন। এর মধ্যে মৃত, প্রবাসী ৫১ জন। আট উপজেলা ও সাত পৌর কমিটিসহ সব ইউনিটের কাউন্সিলরদের ভোট অনুষ্ঠিত হয় চাঁদপুর শহর, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তিতে।
এখানে ভোট পড়ে ৮০৪। এতে সাতজন প্রার্থীর মধ্যে সভাপতি পদে ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হক ৭১১ ভোট, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা খান সফরী ৬৫৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলরদের এই ভোট দেওয়ার উপস্থিত স্বাক্ষর, গোপন ব্যালট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ডকুমেন্টস তাদের কাছে রয়েছে বলে নেতারা জানান।
অপরদিকে জেলা সদরে ভোট দেখানো হয় ৯৯২টি। প্রাপ্ত ফলাফল অনুসারে সভাপতি প্রার্থী শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক ৯২৭ এবং সাধারণ সম্পাদক পদে অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ সেলিম ৮৯২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। কাউন্সিলে উপস্থিত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূইয়া ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া এই কমিটিকে বৈধ ঘোষণা করেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, জেলা সদরে সঠিক ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে সর্বোচ্চ সেখানে ৬৫৬ ভোট পড়ার কথা। কিন্তু ভোটের হিসাবে সেখানে ৩৩৬টি ভুয়া ভোট দেখানো হয়েছে। তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করলে ওই ভুয়া ভোটের হিসাব মেলাতে পারবেন না।
সম্মেলনের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিশন ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ভোটের এই তারতম্য উল্লেখ করা হলেও তারা এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
এ বিষয়ে সম্মেলনে উপস্থিত কুমিল্লা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন ঠিক ছিল, কোনো অনিয়ম দেখিনি। কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে সেখানে ছিলাম। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে সমস্যা ছিল, তা সমাধানের জন্য আমরা আগের দিন সেখানে ছিলাম। বিবদমান সব অংশকে ডাকা হলেও সবাই আসেননি। এখন কেউ যদি না আসে তাহলেও তো কিছু করার নেই। আর জাল বা ভুয়া ভোট আমাদের সামনে দেখিনি।
চাঁদপুর জেলার মতো সিলেট জেলা কমিটিতেও কেন্দ্রের প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। যে কারণে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নিজের নাম প্রত্যাহারের পর ওই কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। দিনাজপুর জেলা কাউন্সিলেও তৃণমূলকে উপেক্ষা করে নানা কৌশলে পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানান, কাউন্সিলের নামে তামাশা করা হয়েছে। বোচাগঞ্জ উপজেলার সভাপতি সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাককে সভাপতি প্রার্থী হতে না দিতে নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। কারণ তিনি তৃণমূলের কাছে জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আর এই কর্মকাণ্ডে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন কেন্দ্র থেকে কাউন্সিল তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। তিনি তার পছন্দের প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য কাউন্সিলরদের (ভোটার) নানাভাবে প্রভাবিত করেন।
তারা জানান, একজন প্রার্থীকে সভাপতি পদে নির্বাচন করতে না দেওয়ার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা করা হয়নি।
প্রথমে যাচাই-বাছাই করে সবার মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। বৈধ ঘোষণার ৮ ঘণ্টা পর হঠাৎ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একক সিদ্ধান্তে সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাকের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করে। পরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আরও একজন কমিশনার পদত্যাগ করেন।
বাকি একজন নির্বাচন কমিশনার পদত্যাগ না করে পিনাকের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করেন। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কাউন্সিলরদের (ভোটার) বলা শুরু করেন কেন্দ্র থেকে নোটিশ আসবে পিনাকের মনোনয়ন বাতিলের জন্য। এটি বলার কারণ যাতে কাউন্সিলরদের মনোযোগ পিনাকের দিকে না থাকে।
শেষ পর্যন্ত ভোটের মাত্র পাঁচ দিন আগে পিনাককে চিঠি দিয়ে জানানো হয় তার প্রার্থিতা গ্রহণ করা হয়েছে।
সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাক যুগান্তরকে বলেন, এমনও হয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা তার এক আত্মীয়কে দিয়ে সাতটি ইউনিটের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডেকে বলেছেন, ওপরের নির্দেশ আছে পিনাককে ভোট দেওয়া যাবে না। পরে নানা নাটকীতার পর ভোটের মাত্র পাঁচ দিন আগে আমার প্রার্থিতা বৈধ বলে চিঠি দেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য হলো এত কম সময়ে তো সব ভোটারের কাছে যাওয়া যাবে না।
আমি যেন ফেল করি, সেজন্য এটা করা হয়। তারপরও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে মাত্র ১১৪ ভোটে হেরে যাই। দুটি থানার নেতাদের কাউন্সিলর করা হয়নি, সেখানে ভোটার ছিল ২০২ জন। আমাকে নানা কৌশল করে হারানো হয়েছে, যা হয়েছে, তা দলীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত লজ্জার কাজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সবকিছু গঠনতন্ত্র মেনে হয়েছে। সাংগঠনিকভাবেই পিনাক চৌধুরীকে অ্যালাউ করা হয়েছে। বিএনপির গঠনতন্ত্র বলে, কোনো ইউনিটের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক থাকলে সে ওপরের লেভেলের কোনো নির্বাচন করতে পারবেন না। তাকে নিচের পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যখন তিনি পদত্যাগ করেছেন, তখন কেন্দ্র থেকেই তাকে নির্বাচন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এটি আমার কোনো ব্যক্তিগত বিষয় না।
তবে জাহিদ হোসেনের বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাক বলেন, আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দিতে সব কাজই করেছেন। একপর্যায়ে আমাকে জানানো হলো দুই পদে থাকলে তা গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। আমি বলেছিলাম, যদি জেলার সভাপতি পদে জয়ী হই তাহলেই তো দুটি পদ হবে। তখন তারা মহাসচিব বরাবর একটি আবেদন লিখতে বললেন-জেলায় জয়লাভ করলে উপজেলার বর্তমান পদ থেকে পদত্যাগ করবেন। এটা কিন্তু একটা স্বাভাবিক বিষয় ছিল, জেলা সভাপতি হলে উপজেলার সভাপতি পদে কি কেউ থাকেন?
অথচ বোচা উপজেলার সিনিয়র সহসভাপতির কাছে নির্বাচনে নামার আগেই কিন্তু দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলাম এবং জেলার আহ্বায়ক কমিটির কাছে চিঠিও দিয়েছিলাম।
ঝিনাইদহের কাউন্সিলেও একই ঘটনা ঘটেছে। জেলার আহ্বায়ককে কৌশলে সভাপতি পদে প্রার্থী হতে দেওয়া হয়নি। সেখানেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন দলটির একই ভাইস চেয়ারম্যান।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট এসএম মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাকে যখন আহ্বায়ক করা হয়, সেই চিঠিতে লেখা ছিল কাউন্সিল হলে আহ্বায়ক কোনো পদে দাঁড়াতে পারবেন না। তখন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানালাম তাহলে আমি এই পদে থাকব না।
কেন্দ্রীয় নেতারা তখন জানালেন, দেশের সব জেলা শাখার চিঠিতেই একই কথা লেখা আছে, কোনো সমস্যা নেই, ভোট করতে পারবেন। তখনই কিন্তু চিঠিটা গ্রহণ করি। কিন্তু হঠাৎ করে কাউন্সিলের আগে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন এসে বললেন, আপনি ভোট করতে পারবেন না। আমি বললাম, আহ্বায়ক করার সময় তো আমাকে বলা হয়েছিল ভোট করা যাবে। গাজীপুর জেলাসহ বিভিন্ন জেলার চিঠিতেও তো একই কথা লেখা ছিল, কিন্তু সেব জেলার আহ্বায়ক তো ভোট করেছেন। আসলে আমার জনপ্রিয়তা দেখেই কৌশলে আমাকে প্রার্থী হতে দেননি।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এজেডএম ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, দলের নিয়ম হচ্ছে যারা আহ্বায়ক হিসাবে থাকেন, তাদেরকে কাউন্সিলে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না। আমি সেটাই অনুসরণ করেছি। তাহলে গাজীপুর জেলার আহ্বায়ক কাউন্সিলে সভাপতি পদে ভোট করেছেন, নির্বাচিতও হয়েছেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের কিছু এখতিয়ার আছে। গঠনতন্ত্রে বলা আছে, অনিবার্য কারণে দলের চেয়ারম্যান ব্যতিক্রম অনুমোদন করতে পারবেন।
এছাড়াও এখন পর্যন্ত গাজীপুর, নীলফামারী ও মানিকগঞ্জ জেলার কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। মানিকগঞ্জ ছাড়া প্রতিটিতেই কেন্দ্র থেকে কোনো না কোনোভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে একটি জেলার উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করতে চাইলে তাকেও করতে দেওয়া হয়নি। কারণ হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে জানান, তিনি কাউন্সিলর নন, তাই প্রার্থী হতে পারবেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা যুগান্তরকে জানান, ভোট যদি গণতান্ত্রিক অধিকার হয়, তাহলে যে কেউ ভোটে প্রার্থী হতে পারবেন-সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার কারণে প্রার্থী হতে পারিনি।