ঈদে জনসমাগম
কোথাও মানা হচ্ছে না ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি
করোনার সামাজিক সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা * মৃত্যুঝুঁকির শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাসের অপেক্ষায় ঘরমুখো মানুষ, ছবি: মিরপুর থেকে তোলা- যুগান্তর
দেশে করোনাভাইরাসের চতুর্থ ঢেউয়ের মধ্যে এবার পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে। ঈদ ঘিরে পশুর হাট, শপিংমল, গণপরিবহণ সবখানে মানুষের উপচে পড়া ভিড়।
ভাইরাসটি রোধে সরকারের একাধিক বিভাগ বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে। কিন্তু কোথাও ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এতে করে বিশেষজ্ঞরা করোনার সামাজিক সংক্রমণ ব্যাপক ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়াসহ মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করছেন।
যুগান্তরকে তারা জানান, শুধু দায়সারা নির্দেশনা দিলে হবে না। এটি বাস্তবায়ন না করতে না পারলে ঈদ-পরবর্তীতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর লাগাম টানা চ্যালেঞ্জ হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের দাবি-করোনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ মোকাবিলাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ধর্ম মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে ২৯ দফা সুপারিশ বা নির্দেশনা দিয়েছে।
এসব নির্দেশনায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদ উদযাপনের কথা বলা হয়েছে। সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করে করোনা মোকাবিলায় নেওয়া উদ্যোগুলো বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে।
কুরবানি ঈদ কেন্দ্র করে সারা দেশে সাত হাজারের বেশি গরুর হাট বসেছে। হাটে প্রবেশের আগে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হলেও শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তা মানছে না।
হাটগুলোতে হাত ধোয়ার জন্য সাবান পানির ব্যবস্থা নেই। কারও মধ্যে উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক করোনার এন্টিজেন পরীক্ষার সুযোগ রাখা হয়নি। অন্য দিকে কেনাকাটার জন্য শপিংমল ও বাজারগুলোতে মানুষের চাপ বাড়লেও সেখানে জীবাণুনাশক টানেল বসানো হয়নি।
একইভাবে বাস, লঞ্চ, ট্রেন স্টেশনে ঘরেফেরা মানুষের ঢল নামলেও কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। এসব জায়গায় মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজ ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করা হলেও কেউই তা মানছে না। গণপরিবহণগুলোতে মানুষ ঠাসাঠাসি করে গ্রামে ছুটছেন।
জানতে চাইলে ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, মানুষ আপনজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনে ভিড় ঠেলে গ্রামে যাচ্ছে। তারা কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
মাস্ক ছাড়া পশুর হাটে ঢুকতে নিষেধ করা হয়েছে। প্রতিটি হাটে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে বলা হয়েছে। গণপরিবহণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
কিন্তু সবখানে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন চরমভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। এতে সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে করোনার ওমক্রিন ধরনের দুটি উপধরন শনাক্ত হয়েছে।
উপধরন বি.এ-৪ ও বি.এ-৫ যা দ্রুত সংক্রমণশীল। অনেকে আক্রান্ত হয়েও উপসর্গহীন থাকছেন। তীব্রতা কম থাকায় বুঝতে পারছেন না। লক্ষণবিহীন ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে কোমরবিডি ভোগা কেউ আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে।
তাই ঈদের মাঠে মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি ও হাত মেলানোর সময় সতর্ক হতে হবে। পশু জবাই, মাংস বণ্টনের সময় মাস্কবিহীন থাকলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে হবে।
এ ছাড়া ঈদ জামাত শেষে আত্মীয় বাড়ি, বিনোদনকেন্দ্রে জনসমাগম হবে। এজন্য মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে সব স্তরের প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। না হলে ঈদের পরে সংক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে সাধারণত কোনো উৎসব না হলে করোনা সংক্রমণ শহরকেন্দ্রিক থাকে।
বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে সংক্রমণ বেশি হয়। এখন ঈদ উদযাপনে অনেকে শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে। কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এভাবে গ্রামেও করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবে।
ঈদের পরে রোগী শনাক্ত বাড়বে। পাশপাশি মৃত্যুও বাড়বে। এ ছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ যেখানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে সেখানেও স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠিন হওয়ায় করোনা বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এজন্য ভালোভাবে মাস্ক পরাসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কঠিন হবে। এজন্য সবাইকে নিয়মিত হাত ধোয়া ও মাস্ক পরতে হবে।
উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নমুনা পরীক্ষা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন করতে হবে। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। যারা পূর্ণডোজ টিকা নেননি তাদের নিতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা রোগতত্ত্ববিদ মোশতাক হোসেন বলেন, করোনার চতুর্থ ঢেউ আসার পর এতদিন ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে বেশি সংক্রমণ হয়।
এখন ঈদে ঢাকার মানুষের বাসস্থান পরিবর্তন হবে। এ ছাড়া গ্রাম থেকে গরু নিয়ে হাটে এসে অনেকে গ্রামে ফিরে করোনা সংক্রমণ গ্রামেও ছড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।
যে হারে সংক্রামিত হবে সে হারে নমুনা পরীক্ষা হবে না। এতে অধিকাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে থাকবে। এতে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। এ জন্য ঈদের জামাত খোলা জায়গায় করতে হবে।
বিয়ে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি বাধ্যতামূলকভাবে পালন করতে হবে। সব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউয়ের মধ্যে শুক্রবার নতুন রোগী শনাক্ত কিছুটা কমে এক হাজার ৬১১ জন হয়েছে।
এদিন সাতজন মারা গেছে। বৃহস্পতিবার এক হাজার ৭৯০ জনের করোনা শনাক্ত হয়। এদিন তিনজন মারা যায়। এর আগের দিন এক হাজার ৭২৮ জন শনাক্ত হয়।
গত একদিনে করোনায় সাতজনের মৃত্যু হওয়ায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ১৯৫ জনে। পাশাপাশি করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ১০১ জন হয়েছে। গত এক দিনে রোগী শনাক্ত হার ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।