পশুর চামড়া পরিস্থিতি
বিশ্ববাজারে বইছে সুবাতাস, শঙ্কা দেশে
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
করোনা অভিঘাতের পর বিশ্ববাজারে এখন চামড়ার বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। গত এক বছরে বিশ্বে চামড়ার গড় মূল্য বেড়েছে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। একই সময়ে বেড়েছে রপ্তানির চাহিদাও। কিন্তু দেশে কুরবানির পশুর চামড়ার বাণিজ্যের সুফল নিয়ে শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
কারণ প্রতিবছর এই মৌসুমে সিন্ডিকেট করে মূল্যের ভয়াবহ ধস নামানো হয়। এ বছর এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব। এরই মধ্যে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কেমিক্যাল ও কনটেইনার ভাড়া বেশি গুনতে হচ্ছে ট্যানারির মালিকদের।
তবে সরকারিভাবে জানানো হয়েছে, কুরবানির চামড়ার বাজার অস্থিতিশীল প্রতিরোধে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সমস্যা সমাধানে যৌথ সমন্বয়সহ ১১টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঈদের দিন থেকেই শুরু হবে এসব কমিটির কার্যক্রম।
সূত্রমতে, করোনাভাইরাস শুরু এবং এর আগ থেকে বিশ্ববাজারে চামড়ার মূল্য নিম্নমুখী ছিল। ২০১৮ সালে বিশ্ববাজারে চামড়ার গড় মূল্য পতন ঘটে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০১৯ ও ২০২০ সালে ধারাবাহিকভাবে ৮ দশমিক ৩ এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ হ্রাস পায়।
বিশেষ করে করোনার সময় ২০২০ সালে বিশ্ববাজারে চামড়া রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি আসে। তবে ২০২১ সালে অবিশ্বাস্যভাবে এর মূল্য বৃদ্ধি পায়। ওই বছরে গড় মূল্য বেড়েছে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই মূল্যবৃদ্ধি ২০২২ সালেও অব্যাহত আছে।
বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক রিপোর্টে দেখানো হয়, ২০২৮ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে এর চাহিদা বাড়বে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজার ছিল ৩৯ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারে এবং ২০২৮ সালে তা দাঁড়াবে ৬২ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সুবাতাসের প্রতিফলন এরই মধ্যে বইছে দেশের রপ্তানি খাতে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সূত্রে সদ্য বিদায়ি অর্থবছরে (২০২১-২২) চামড়া খাতে রপ্তানি আয় হয় ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। যদিও এ সময় রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১০৩ কোটি ডলার।
বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ভালো থাকার ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি চামড়া রপ্তানি হয়। এটি গত বছরের তুলনায় ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি আয় ও বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ভালো থাকার সুফল কতটুকু আসন্ন কুরবানির মৌসুমে পড়বে, এ নিয়ে অনেকটা উদ্বিগ্ন ক্ষুদ্র, ছোট ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এই মৌসুমে সারা দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। একে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু পরিকল্পিতভাবে চামড়ার প্রকৃত দাম ফেলে দিয়ে কম দামে কেনার প্রবণতা থেকে প্রতিবছরই কুরবানির চামড়া ঘিরে একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়। বিশেষ করে এটি ট্যানারি মালিকদের মধ্যে গড়ে ওঠে। এটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সম্পৃক্ত হয় অনেক আড়ত মালিক। যে কারণে চামড়া কেনাবেচার মূল্য সরকার ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত মূল্যে বড় ধরনের ধস নামে।
বিশ্ববাজারে গত এক বছরে মূল্য বাড়লেও কাঁচা চামড়ায় কেনাকাটায় একই সময়ে দেশের ভেতর কোনো মূল্য বাড়েনি। তবে এক বছর পর গরুর চামড়ায় প্রতি বর্গফুটে ৭ টাকা এবং খাসিতে ৩ টাকা বাড়িয়ে মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার।
ওই হিসাবে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় কেনা হবে ৪৭-৫২ টাকা, গ্রামে ৪০-৪৪ টাকা। এছাড়া খাসির চামড়া প্রতি স্কয়ার ফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১২-১৪ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে ইউরোপের মানুষের অবস্থা ভালো নেই। চামড়া একটি শৌখিন পণ্য। ফলে ইউরোপে এর চাহিদা কমছে। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে চামড়া খাতে ব্যবহৃত সব ধরনের কেমিক্যালের মূল্য ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বেড়েছে লবণের দামও। সব মিলে পরিস্থিতি ভালো নয়। এর মধ্যে বেঁধে দেওয়া মূল্যও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে। এর প্রভাবে কনটেইনার খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। ফলে আমরা এসব বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন।
জানা যায়, কুরবানির চামড়ার বাজার স্বাভাবিক রাখতে এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্য সচিবকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় যৌথ সমন্বয় কমিটি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের সমন্বয় ও মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি বাজারে অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে বাজারে লবণ সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। অন্য সব মনিটরিং টিমকে তত্ত্বাবধান করবে।
জানতে চাইলে কুরবানির কাঁচা চামড়া সংক্রান্ত সমন্বয় ও মনিটরিং প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুসরাত জাবীন বানু যুগান্তরকে বলেন, চামড়া সংরক্ষণ, ক্রয়/বিক্রয় ও পরিবহণসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য এরই মধ্যে সব ধরনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী ৫ দিন এসব কমিটি প্রয়োজনীয় মনিটরিং করবে। বিশেষ করে নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় ও বিক্রয় মনিটরিং করা হবে।
অন্যান্য কমিটির মধ্যে বাংলাদেশ চা বোর্ডের সদস্য মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরীকে প্রধান করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট চট্টগ্রাম বিভাগের মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফকরুল ইসলামকে প্রধান করে সিলেট বিভাগের জন্য চার সদস্যের মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। এছাড়া ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের রাজশাহী কার্যালয়ের উপপরিচালক অপূর্ব অধিকারিকে প্রধান করে ওই অঞ্চলের জন্য চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
খুলনা বিভাগের মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে টিসিবির উপ-ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রবিউল মোর্শেদকে প্রধান করে এবং ময়মনসিংহ বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপপ্রধান মাহমুদুল হাসান।
এছাড়া রংপুর ও বরিশালের দায়িত্বে আছেন আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রক রংপুর দপ্তরের নির্বাহী অফিসার সফিউল আলম এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের নির্বাহী অফিসর আল-আমীন হাউলাদার। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। এছাড়া চামড়া ক্রয় ও বিক্রয় কার্যক্রম মনিটরিং করবেন।