Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন

তদন্তে সন্দেহজনক সাড়ে ৫ হাজার লেনদেন

জড়িত এক শ্রেণির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী -ড. মইনুল ইসলাম

Icon

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তদন্তে সন্দেহজনক সাড়ে ৫ হাজার লেনদেন

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার ব্যাংক লেনদেনকে সন্দেহজনকভাবে শনাক্ত করেছে বিএফআইইউ। চলতি অর্থবছরের গেল আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এমন চিত্র ধরা পড়ে।

এটি করতে গিয়ে গ্রাহকের সোয়া ২ কোটির বেশি আর্থিক লেনদেন (সিটিআর) যাচাই-বাছাই করা হয়। এক্ষেত্রে অর্থ পাচার ছাড়াও মোট ২৭টি ক্যাটাগরিতে এসব লেনদেনে অপরাধ সংঘটিত হতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছে।

তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্টভাবে যেসব লেনদেনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ মিলবে সেসব লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ রকম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলোকে। 

তবে এমন উদ্যোগ নিয়ে তেমন একটা আশাবাদী নন অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। বিএফআইইউর দেশ থেকে পুঁজি পাচার ঠেকানো নিয়ে তিনি খুবই সন্দিহান।

তার মতে, অর্থ পাচারের সঙ্গে সমাজের এক শ্রেণির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী জড়িত। ফলে বর্তমান সরকার এটি প্রতিরোধ করতে পারবে বলে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।

অর্থ পাচার নিয়ে দেশের সর্বত্র এখন আলোচনার ঝড় বাইছে। সম্প্রতি তথ্য বেরিয়েছে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে।

মাত্র ১২ মাসে সেখানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন বাংলাদেশিরা। সব মিলিয়ে সুইস ব্যাংকে এখন বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৫ কোটি, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা নিয়ে সংসদেও নানা উত্তাপ ছড়িয়েছে। রীতিমতো বিরোধী দলগুলোর তোপের মুখে পড়ে সরকার।

প্রশ্ন উঠেছে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়েও। এমন পরিস্থিতিতে অর্থ পাচার প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকর ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা মাসুদ বিশ্বাস মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সিটিআর ও এসটিআর (সন্দেহজনক লেনদেন) রিপোর্টের সংখ্যা বেশি হওয়ার মানে হচ্ছে-ব্যাংকগুলোর সচেতনতা বাড়ছে।

আগে ভয়-ভীতি থেকে এসব রিপোর্ট কম হতো। এখন বিভিন্ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও কর্তৃপক্ষের প্রচার-প্রচারণার কারণে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই কার্যক্রম বেশি হচ্ছে।

আর এ ধরনের রিপোর্টের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিএফআইইউ অধিক পর্যালোচনার সুযোগ পাচ্ছে। ভালো ও মন্দ লেনদেন শনাক্ত করতে পারছে।

সূত্রমতে, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০২১-২২ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ কোটি ৩২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৫টি নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউতে পাঠিয়েছে।

এরমধ্যে ৫ হাজার ৩১২টি লেনদেনকে সন্দেহজনক (এসটিআর) হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।

এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৬টি লেনদেন তল্লাশির জন্য পাঠানো হয় বিএফআইইউতে।

ওই অর্থবছরে সন্দেহজনক হিসাবে ৫ হাজার ২৮০টি লেনদেনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৭৫ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে ৩ হাজার ৫৭৩টি। 

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ধারা ২-এর(য) উপধারায় সন্দেহজনক লেনদেন বলতে বোঝায় ‘যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হইতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হইতে অর্জিত সম্পদ বা কোনো সন্ত্রাসী কার্যে, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন।

ব্যাংকিং নিয়মে একজন গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট দিনে তার অ্যাকাউন্টে একাধিক বা একটি লেনদেনের মাধ্যমে দশ লাখ টাকা বা তারও বেশি জমা বা উত্তোলন করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে সিটিআর রিপোর্ট করে ব্যাংক।

সারা মাসে এ ধরনের লেনদেন তালিকাভুক্ত করে একটি নির্দিষ্ট তারিখে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) কাছে।

কিন্তু কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করে। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বিএফআইইইতে পাঠানো করা হয়।

কারণ এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সন্দেহ হিসাবে দেখে। আরও জানা গেছে, বিএফআইইউ সিটিআর এবং এসটিআর তালিকায় থাকা লেনদেনগুলো আরও অধিকভাবে যাচাই বাছাই করে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা একাধিক সার্ভারে গ্রাহকের লেনদেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এরপর যেসব লেনদেন সন্দেহজনক হয় সেক্ষেত্রে সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আরও অধিকতর তদন্ত ও অনুসন্ধানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়।

তবে এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন, ঘুস, দুর্নীতি, মাদক, চোরাচালনসহ ২৭ ধরনের অপরাধ ভাগ করা আছে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী সন্দেহজনক লেনদেনগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়।

যেমন-ঘুস ও দুর্নীতি হলে দুদক, মাদক হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, চোরাচালান হলে পুলিশের কাছে পাঠানো হয়।

তবে ২৭টি ক্যাটাগরির মধ্যে ২৩ থেকে ২৪টিই পুলিশের কাছে পাঠানো হয় তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদন্ত ও অনুসন্ধানে সত্যতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। 

বিএফআইইউর সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, সিটিআর চেক করতে করতে বোঝা যায় কোন লেনদেনটি ভালো ও কোনটি মন্দ। এটি এক ধরনের ক্যাশ লেনদেনের মনিটরিং টুলস।

সেখান থেকে কোনো মন্দ লেনদেন চিহ্নিত হলে বিএফআইইউ আরও অধিক তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়। তারা এটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।

তিনি বলেন, সিটিআর থেকে সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে। তবে সব সন্দেহজনক লেনদেন খারাপ নয়। দেখা গেছে একজন গ্রাহক হঠাৎ তার হিসাবে লাখ লাখ টাকা লেনদেন করছেন।

ব্যাংকে বসে আমরা ওই গ্রাহক সম্পর্কে জানতে পারছি না। তখন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তারা বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করে।

প্রতিরোধ কার্যক্রম হিসাবে তথ্য বিনিময় করতে সর্বশেষ ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বিএফআইইউ। এনিয়ে ৭৮টি দেশের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম