বর্ধিত ভর্তুকির ব্যয় মেটাতে কৃচ্ছ্রসাধন
কমছে ৩৫০০ কোটি টাকা
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ১১ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসাবে সরকারি চাকরিজীবীরা আগামী অর্থবছরে গৃহনির্মাণ ঋণ কম পাবেন। একইভাবে হাত দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সম্মানি ও বিশেষ ব্যয়ের ক্ষেত্রে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে যে অনুদান দেওয়া হতো, আগামী বছর তা কমানো হবে। যে কারণে অর্থবছরের শুরুতেই এ খাতে ব্যয় কর্তন করে নতুন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের ১৩টি খাত থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করবে সরকার। এজন্য ওইসব খাতে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেট (২০২২-২৩) বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈশ্বিক সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কয়েকটি পণ্যে। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষকের সার। এই চারটি পণ্যে আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় অনেক বেশি বাড়বে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে ৬৬ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে এসব খাতে ভর্তুকি গুনতে হবে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বেশি ভর্তুকি ব্যয় করতে হবে ১৪ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। তবে আগামী অর্থবছরের শেষদিকে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভর্তুকি বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কা করছে অর্থ বিভাগ। কারণ ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়েছে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্যকে ভিত্তি ধরে। কিন্তু এই মূল্য অর্থবছরের শেষদিকে ঠিক নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আরও বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। এই ভর্তুকি ব্যয় মেটাতে সরকার অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে কৃচ্ছ্রসাধনের পথে হাঁটছে। এতে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে অর্থ সাশ্রয় করে ভর্তুকিতে সংস্থান করা যাবে।
সূত্র আরও জানায়, কৃচ্ছ্রসাধন ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের লক্ষ্যে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া হবে। বিশেষ করে যেসব প্রকল্প থেকে রাজস্ব আহরণ হবে এবং রাজস্ব আহরণে কাজে আসবে, সে প্রকল্পগুলোয় অর্থায়ন বাড়ানো হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বা রাজস্ব আয়ে কাজে আসবে না এমন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া হবে। এমন সিদ্ধান্ত আগামী অর্থবছরের প্রথম জুলাই থেকে কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
জানা যায়, আগামী অর্থবছরে উল্লিখিত খাত ছাড়া আরও যেসব অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে ব্যয় সাশ্রয় করার হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার আওতায় ফি ও চার্জ প্রদান, মুদ্রণ ও মনিহারি ক্রয়, বিশেষ ব্যয়, পরিবহণ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটা, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয়, চাষকৃত জৈব সম্পদ, উইপেন সিস্টেম, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাসামগ্রী সরবরাহ, মূল্যবান দ্রব্যাদি, রেলওয়ে কন্টিনেন্টাল সাসপেন্ট স্টোর। আগামী বছরের কৃচ্ছ্রসাধন প্রসঙ্গে অর্থ সচিব (সিনিয়র) আবদুর তালুকদার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আগামী অর্থবছরে কৃচ্ছ্রসাধন করা হবে। সরকারি পর্যায়ে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আগামী পহেলা জুলাইয়ের পর আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। স্বল্পগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এ বছর না হয়ে পরবর্তী বছরে পিছিয়ে দেওয়া হবে।
সূত্রমতে, প্রতিবছর সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাধারণ অনুদান দেয়। চলতি বছর অনুদানের অঙ্ক ৪৮ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। এ খাতে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা কমিয়ে বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকা।
একইভাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার জন্য পরিবহণ কেনাকাটায় বরাদ্দ কমছে ১৩৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৮ হাজার ৮০ কোটি টাকা। বর্তমানে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৮ হাজার ২১৫ কোটি টাকা।
এছাড়া বরাদ্দ কমানো হয়েছে পরিবহণ যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়। এ খাতে ৩৫৪ কোটি টাকা কমানো হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। বর্তমানে অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা, যা আগামী অর্থবছরে এ খাতে রাখা হয়েছে ২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। যন্ত্রপাতির বড় একটি অংশ আমদানি হয় বিদেশ থেকে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে এ খাতে কম আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
মুদ্রণ ও মনিহারি পণ্য সব মন্ত্রণালয়কে কেনাকাটা করতে হয়। তবে এটি আগামী বছর কম কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে মুদ্রণ ও মনিহারি পণ্য কেনাকাটায় ৮৩ কোটি টাকা কম দেওয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা, যা বর্তমান বরাদ্দ আছে ২ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা।
সরকারি প্রশিক্ষণ, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, বিদেশ ভ্রমণ ও কর্মশালাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সম্মানি দেওয়া হয়। আগামী দিনে এ খাতে ব্যয় কমানো হবে প্রায় ২৩৩ কোটি টাকা। এমন সিদ্ধান্ত থেকে সম্মানিতে ৬১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ আছে ৮৫২ কোটি টাকা।
এছাড়া বিশেষ ব্যয় খাত রয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় এ খাত থেকে বিশেষ প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারবে। এমন খাত থেকে আগামী দিনে ২৫৪ কোটি টাকা কমানোর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে আছে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
বিভিন্ন ধরনের ফি ও চার্জ বাবদ ৯৭ কোটি টাকা ব্যয় কম করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে আগামী বছরে। ওই হিসাব মাথায় রেখে আগামী দিনে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ১ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে আছে ১ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা।
আরও যেসব খাত থেকে সাশ্রয় করা হবে এর মধ্যে রয়েছে ইউপেন সিস্টেম থেকে ১২৫ কোটি টাকা, রেলওয়ে কন্টিনেন্টাল সাসপেন্ট স্টোর থেকে ৭৫ কোটি, সরকারি চাকরিজীবীদের গৃহনির্মাণ ঋণ থেকে ৬৩ কোটি, মূল্যবান দ্রব্যাদি থেকে ২৭ কোটি, চাষকৃত জৈব সম্পদ থেকে ১৩ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাসামগ্রী সংগ্রহ থেকে ১৭ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, বৈশ্বিক সংকট (রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বিশ্ববাজারে পণ্যের বর্ধিত মূল্য) এবং দেশের ভেতর মূল্যস্ফীতি চাপ অর্থনীতিকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। ফলে অর্থনীতি এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মানুষের আয় বৃদ্ধি অব্যাহত রেখে প্রণোদনার কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করা। এর মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করা হবে। পাশাপাশি ভর্তুকির বর্ধিত মূল্য সংস্থান করতে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে আরও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করা হবে।