রাজনৈতিক উদ্দীপনার পরিসংখ্যান

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
প্রকাশ: ১০ জুন ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক সংকটের স্বীকৃতি আছে। তবে সমস্যার মূল উৎস হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বৈশ্বিক খাত। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রত্যাশা নেই।
এ ছাড়াও সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিম্নমুখী থাকলেও মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব লক্ষ্যমাত্রা রাজনৈতিক উদ্দীপনার পরিসংখ্যান মনে হয়েছে।
ব্যয়ের কাঠামোতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে কর কাঠামোতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার বেশিরভাগই সমর্থনযোগ্য।
অর্থনৈতিক বিবেচনায়, বাজেট বিশ্লেষণে যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো, এবার অর্থমন্ত্রী স্বীকার করলেন, অর্থনীতিতে সমস্যা আছে। তবে তিনি সমস্যার মূল উৎস দেখছেন বিশ্ব-অর্থনীতিতে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির পুরোটাই বিদেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। তবে কর আদায় কম, সঞ্চয় কমে যাচ্ছে-এগুলোতে তিনি তত গুরুত্ব দেননি। এর ফলে এবারের বাজেটে সমন্বিত কার্যক্রম দেখিনি।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আর্থিক কাঠামোর ভেতরে বিনিয়োগের হার ধরা হয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি আগের বছরের চেয়েও কম বা কাছাকাছি। অর্থাৎ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি বড় কোনো প্রত্যাশা করছেন না। লক্ষণীয় বিষয় হলো বিনিয়োগের ভেতরে মূল স্তম্ভ বা চালিকাশক্তি ছিল সরকারি বিনিয়োগ। কিন্তু অর্থবছরে সেটি কমে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা কমিয়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এখানে আরও কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এর মধ্যে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ আছে। সেখানে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নিয়ে আসবে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো মূল্যস্ফীতির পুরোটাই যদি আমদানিকৃত বৈদেশিক পণ্যের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে এটা কীভাবে কমবে, তা পরিষ্কার নয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, রফতানির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ২০ শতাংশ। কিন্তু আমদানি প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ। অথচ আমরা জানি পণ্যমূল্য বাড়লে আমদানি বাড়বে। একইভাবে চলতি বছরে প্রবাসী আয় সামান্য বাড়লেও আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ শতাংশ। এই হিসাবগুলো অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো বিনিয়োগ সংযত অবস্থায় এবং সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নমুখী। এরপরও জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ শতাংশ ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো এসব সব সমস্যা মোকাবিলা করার পরও এই হারে প্রবৃদ্ধি থাকে কীভাবে। ফলে এতদিন জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে সংশয় ছিল, তা আবার জোরদার হয়েছে। এ কারণে আমি মনে করছি, এটি বাজেটীয় লক্ষ্যমাত্রা নয়, রাজনৈতিক উদ্দীপনার পরিসংখ্যান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে কর আহরণ ও প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর চেষ্টা রয়েছে। এরপরও ভ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা থাকবে। এক্ষেত্রে ইতিবাচক হলো যেহেতু আমদানি পণ্যের দাম বেশি। তাই আমদানি শুল্ক কিছুটা বাড়বে। এ ছাড়া ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ভালো-খারাপ দুদিকেই ভর্তুকি হয়। যেমন ভালো ভর্তুকি হলো প্রত্যক্ষভাবে মানুষকে আর্থিক ও খাদ্য সাহায্য দেওয়া। খারাপ হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে লক্ষ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া।
কিন্তু খাদ্য খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। অপরদিকে সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আগে যা বরাদ্দ ছিল, জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ সেখানেই আছে। স্বাস্থ্য খাতে এবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে জিডিপির অনুপাতে শূন্য দশমিক ৮৩, শিক্ষায় ১ দশমিক ৮৩ এবং সামাজিক সুরক্ষায় শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ। ফলে ব্যয় কাঠামোয় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কর কাঠামোতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, তার অনেকগুলোই সমর্থনযোগ্য। এর মধ্যে প্রতিবন্ধীদের কাজ দিলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধা দেওয়া অন্যতম।
এ ছাড়াও করপোরেট কর কমানো সঠিক পদক্ষেপ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, তালিকাভুক্তির বাইরে এবং ব্যাক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর কমানো হয়েছে। কিন্তু নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য করমুক্ত আয় সীমা আগের জায়গাতেই রয়েছে। ফলে এটি ন্যায্য পদক্ষেপ হলো না।
আরেকটি বিষয় হলো অর্থমন্ত্রী বিদেশে অর্জিত সম্পদ ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। আমরা সহজ বাংলায় একে পাচার করা টাকা বলি। এই টাকা ফিরিয়ে আনতে চান তিনি। এটি নিতান্তই হটকারী সিদ্ধান্ত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিকভাবে যখন বৈধ সম্পদের খোঁজখবর হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে নির্বাচনের আগের বছরে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত বড় ধরনের রাজনৈতিক প্রশ্নের জন্ম দেবে। এতে বর্তমান সরকারের অনেক জনকল্যাণমূলক কাজকে ম্লান করে দেবে। আগে আমরা দেশের কালো টাকা নিয়ে বলতাম। এখন আমরা বিদেশের কালো টাকায় হাত দিয়েছি। এটি সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি ও কর ন্যায্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
লেখক : সম্মানীয় ফেলো, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)