পাচারের অর্থ ফেরালে অপরাধ মাফ
যত খুশি ডলার আনা যাবে
হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরাতে বিশেষ ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তাই আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের মতো পাচারকারীদের ট্যাক্স অ্যামনেস্টি (আয়কর দিলে দণ্ড মাফ) সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ পন্থায় কেউ অর্থ ফেরত আনলে দেশের অন্য কোনো আইনেও এ নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এক্ষেত্রে পরিশোধ করতে হবে নির্ধারিত কর। এ সুবিধা এক বছরের জন্য দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেভাবেই হোক বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করলে বা বিদেশ থেকে রপ্তানির অর্থ দেশে না আনলে বিদ্যমান আইনে সেটি অর্থ পাচার হিসাবে বিবেচিত হয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে বা আইনের ভয়ে যে অর্থ বিদেশে রাখা হচ্ছে, তা দেশে আনতে অনেকেই ভয় পেয়ে থাকেন।
এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্যই মূলত আগামী বাজেটে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট অঙ্ক কর দিয়ে যে কেউ তার আয়কর রিটার্নে ওই অর্থসম্পদ প্রদর্শন করতে পারবেন। এই অর্থসম্পদের বিষয়ে সরকারের অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না এবং প্রচলিত আইনে বিচারের আওতার বাইরে থাকবেন।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অর্থ পাচার করলে অথবা অর্থ পাচারের চেষ্টা, সহায়তা বা ষড়যন্ত্র করলে সর্বনিম্ন ৪ বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেই অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড পরিশোধে ব্যর্থ হলে অপরিশোধিত অর্থদণ্ডের পরিমাণ বিবেচনায় অতিরিক্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। পাশাপাশি আদালত অর্থদণ্ড বা দণ্ডের অতিরিক্ত হিসাবে দণ্ডিত ব্যক্তির সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে তিনভাবে ট্যাক্স অ্যামনেস্টি দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, বিদেশে স্থাবর সম্পত্তি থাকলে সেই সম্পত্তি দেশের আয়কর রিটার্নে দেখাতে চাইলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অস্থাবর সম্পত্তির ওপর ১০ শতাংশ কর দিতে হবে।
তৃতীয়ত, কেউ বিদেশ থেকে টাকা দেশে আনলে সেই টাকার ওপর ৭ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখাতে পারবেন। এক্ষেত্রে ব্যাংক হিসাবে টাকা যোগ হওয়ার আগেই কর পরিশোধ করতে হবে। সব ক্ষেত্রেই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না। এমনকি আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে না।
স্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে এমন সম্পদ, যা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা যায় না। যেমন: জমি, ফ্ল্যাট, আবাসিক ভবন, শিল্পকারখানা বা জমিতে অবস্থানরত সম্পদ (গাছপালা)। আর অস্থাবর সম্পত্তি হচ্ছে স্থানান্তরযোগ্য সম্পদ। যেমন: অর্থ, অলংকার, ঘড়ি বা অন্য মূল্যবান ধাতব পদার্থ। যেগুলো সহজেই স্থানান্তর করা যায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ১৭টি দেশ ট্যাক্স অ্যামনেস্টি সুবিধা দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি, গ্রিস, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন ও আমেরিকার কয়েকটি রাজ্য এ সুবিধা দিয়েছে। করের স্বর্গরাজ্য থেকে অর্থ ফেরাতে ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া সরকার ট্যাক্স অ্যামনেস্টি সুবিধা দেয়। এ সুবিধা দিয়ে ৯ মাসে দেশটি ৯৬১ কোটি ডলার কর আদায় করে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের সুযোগ দেওয়া ঠিক নয়। এটা অনৈতিক কাজকে আরও উৎসাহিত করবে। যদি কেউ বুঝতে পারে বিদেশে টাকা পাচারের পর তা দেশে আনতে কর ট্যাক্স দিয়েও বৈধ করা যাবে, তাহলে মানুষ কেন ২৫-৩০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দেবে। আর অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েও কালোটাকা সাদা করা যায়নি। নতুন নিয়মে কেউ টাকা দেশে আনবে বলে মনে হয় না।
এদিকে ডলার সংকট কাটাতে বিদেশ থেকে ডলার আনার প্রক্রিয়াও সহজ করেছে সরকার। ফলে প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো। আবার এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হবে।
এর আগে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার বা পাঁচ লাখ টাকার বেশি আয় পাঠাতে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। যে কারণে এর চেয়ে বেশি অর্থ একবারে পাঠাতে পারতেন না বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে বিদেশ থেকে তাদের অবাধে টাকা আনতে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ নিয়ে বিদেশেও কেউ প্রশ্ন করবে না, আর দেশে তো করবেই না। সরকারের সিদ্ধান্তে গত ২৩ মে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘এর ফলে দেশে প্রবাসী আয় বাড়বে। কিন্তু প্রকৃত উপকার পাবেন দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তারা অবৈধ টাকা বিদেশে পাঠিয়ে বৈধ চ্যানেলে তা দেশে নিয়ে আসবেন। এতে তাদের কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে। তবে সংকট কাটাতে এই অর্থ দেশের জন্য উপকারে আসবে। কারণ, ডলারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে ডলার প্রয়োজন।’