সম্পদের হিসাব দিতেই হবে
মঙ্গলবার সচিব সভায় উঠছে খসড়া * গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অংশ নিতে লাগবে অনুমোদন
বাহরাম খান
প্রকাশ: ২৮ মে ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী একাধিকবার সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার বেলা ৩টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় বিধিমালার সংশোধন খসড়া উঠতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি থাকছে প্রস্তাবিত সংশোধনে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, সম্পদের হিসাব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারসহ প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে সংশোধন প্রস্তাব করা হয়েছে। বিধিমালাটি সংশোধন হলে এ বিষয়গুলোতে সরকারি কর্মচারীরা স্পষ্ট ধারণা পাবেন।
জানা গেছে, সংশোধন প্রস্তাব অনুযায়ী সচিব সভায় বিধিমালাটি পাশ হলে সম্পত্তির হিসাব না দেওয়ার জন্য কোনো অজুহাতই দাঁড় করাতে পারবেন না সরকারি কর্মচারীরা। প্রতি বছর আয়কর বিবরণী জমা দিলেও সরকারের নির্ধারিত দপ্তরে সম্পদের হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে। ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-২০২২’ চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে এটি সরকারি চাকরি আইনের অধীন হবে। এর মাধ্যমে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি আইনি রূপ পাবে।
বিদ্যমান বিধিমালায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান থাকলেও আয়কর বিবরণীর বিষয়টি উল্লেখ নেই। ফলে যারা আয়কর বিবরণী জমা দেন, তারা এটিকে অজুহাত দেখিয়ে সম্পদের হিসাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এর আগে একাধিকবার নির্দেশনা দেওয়ার পরও সম্পদের হিসাব দেননি বেশির ভাগ সরকারি কর্মচারী।
সংশোধিত বিধিমালার খসড়া অনুযায়ী, এনবিআরে সম্পদের হিসাব দিলেও সরকারি কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে পৃথকভাবে সেই হিসাব জানাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত ছক পূরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাঁচ বছর অন্তর ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দিতে হবে।
আয়করের বিবরণী জমা দিলেও চলবে, যদি এর বাইরে অন্য কোনো সম্পদ না থাকে। সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ কোন দপ্তর হবে তা গেজেটের মাধ্যমে জানানো হবে। বিদ্যমান বিধিমালায় পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও কোন মাসের মধ্যে কোন দপ্তরে জমা দিতে হবে তা উল্লেখ নেই।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত বিধিমালায় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অংশ নিতে সরকারি চাকরিজীবীদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে সরকারের উন্নয়নকাজ সম্পর্কিত বিষয়ে দায়িত্বশীলরা অনুমতি ছাড়া কথা বললেও তা ইতিবাচক হিসাবে দেখা হবে। আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বামী বা স্ত্রীদের কেউ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে তা জানাতে হবে।
বিদ্যমান বিধিমালায় কোম্পানি স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের বারণ আছে। প্রস্তাবিত সংশোধনে এটা বহাল থাকলেও সরকারের অনুমতিক্রমে নিবন্ধনকৃত সমবায় সমিতি স্থাপন ও ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবেন কর্মচারীরা। এ ছাড়া বেতন কাঠামোর ১৭-২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারীরা সরকারি কাজের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন। তবে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবসা করতে গেলে অনুমোদন নিতে হবে।
একই সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তার এখতিয়ারাধীন এলাকায় নিজ পরিবারের সদস্যকে সরকারের অনুমোদন না নিয়ে ব্যবসায় জড়াতে পারবেন না।
প্রস্তাবিত বিধিমালার খসড়ায় সরকারি দলিলাদি বা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কঠোর ধারাই বহাল রাখা হচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বা সাংবাদিকদের কারও কাছেই তথ্য দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইনের আওতাধীন তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না থাকার বিষয়টি নতুনভাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালে সেই উদ্যোগটি প্রায় চূড়ান্ত ছিল। তখন সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন হওয়ায় এ আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিধিমালাটি নতুন সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও চলে গেছে আরও চার বছর। এবার বিধিমালাটি আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রস্তাবিত সংশোধনে সম্পদের হিসাব না দিলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে তারও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনেকে শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সম্পদ পাওয়ার কথা উল্লেখ করে দুর্নীতির সম্পদ ঢাকতে চান। এসব বিষয় যাতে ঠিকমতো যাছাই করা হয় সেই সক্ষমতাও থাকতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব পাওয়ার পর সন্দেহজনক কর্মচারীদের সম্পদ যাছাই করে দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
না হলে এখন সম্পদের হিসাব না পেয়ে যা অবস্থা, হিসাব পেয়েও যদি সেটা সরকারের দপ্তরে পড়ে থাকে, তাহলে লাভ হবে না। যারা সব সম্পদের হিসাব দেবে না তাদের লুকানো সম্পদ খুঁজে বের করতে হবে। আর যাদের সম্পদের হিসাব সন্দেহজনক মনে হবে তাদের সম্পদ কিভাবে অর্জিত হয়েছে তা সূক্ষ্মভাবে যাছাই করে শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে। শাস্তির উদাহরণ সৃষ্টি করতে না পারলে যতই বিধিমালা সংশোধন হোক, জনস্বার্থে সেটা কাজে আসবে না।
সরকার চাইলে বিদ্যমান বিধিমালাতেই বাধ্যতামূলকভাবে সম্পদের হিসাব নিতে পারে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সরকার যে বিষয়ে গুরুত্ব দেয় সেটা বাস্তবায়ন হতে বাধ্য। সরকার তা চায় কিনা-সেটাই বড় বিষয়। বাংলাদেশে আইন-কানুনের খুব বেশি ঘাটতি নেই, সমস্যা আইন-বিধি প্রয়োগে।