জমি কেনার নামে অর্থ আত্মসাৎ
নর্থ সাউথের চার ট্রাস্টিকে পুলিশে দিলেন হাইকোর্ট
অর্থ পাচার ও দুর্নীতি হত্যার চেয়েও বিপজ্জনক অপরাধ * পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন বেনজীর * রাতে চারজনকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা নিয়ে অর্থ আত্মসাতের মামলায় ট্রাস্টি বোর্ডের চার সদস্যের জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাদের শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে।
এরপর রাত ১১টার দিকে তাদের থানায় নেওয়া হয়। শাহবাগ থানার ডিউটি অফিসার রাজু মুন্সী যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আজ (সোমবার) সকালে তাদের ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে হাজির করা হবে।
এর আগে শুনানিকালে আদালত বলেন, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি হত্যার চেয়ে বিপজ্জনক অপরাধ। একটি হত্যা একজন ব্যক্তি বা পরিবার বা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। কিন্তু অর্থ পাচার ও দুর্নীতি দেশ এবং জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
জামিন আবেদন আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে না হওয়ায় তা খারিজ করা হলো। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এ চার আসামি হলেন-বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এমএ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান ও মোহাম্মদ শাহজাহান।
এদিকে, আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে গোপনে এজলাস কক্ষ থেকে বেরিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন বেনজীর আহমেদ। তার উদ্দেশ্য ছিল গ্রেফতার এড়ানো। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি কয়েকজন সংবাদকর্মী ও একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টিগোচর হয়।
সংবাদকর্মীরা তার পিছু নেন। এ সময় আদালতের আদেশ অমান্য করে এভাবে চলে যাওয়ার কারণ তার কাছে জানতে চান তারা। এতে বেনজীর আহমেদ হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। বিষয়টি দেখে রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ও কোর্টের কর্মকর্তারা তাকে এজলাস কক্ষে নিয়ে আসেন। পরে তাকে পুলিশ হেফাজতে দেওয়া হয়।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ৫ মে মামলাটি করে দুদক।
ছয়জনের মধ্যে ওই চারজন আগাম জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর ওপর বুধবার শুনানি হয়। ওই দিন আদালত পক্ষগুলোকে শুনানির সারসংক্ষেপ লিখিত আকারে জমা দিতে বলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন।
ধার্য দিনে আবেদনকারী পক্ষ সারসংক্ষেপ লিখিত আকারে জমা দিতে সময়ের আরজি জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রোববার দুপুর ২টা পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি করেন।
একই সঙ্গে আবেদনকারীদের নির্ধারিত সময়ে আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় রোববার দুপুর সোয়া ২টার দিকে জামিন আবেদনের শুনানি হয়। এ সময় চার আবেদনকারী আদালতে হাজির ছিলেন।
আসামিদের জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন-তিন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, এএফ হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল ও মিজান সাঈদ। দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। শুনানিতে আসামিদের আইনজীবীরা বলেন, অনুমানের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়েছে।
কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ নেই। মামলার প্রাথমিক বিবরণে কারও কারও বিরুদ্ধে টাকার পরিমাণের কথা উল্লেখ থাকলেও সেটি অনুমানের ভিত্তিতে বলা আছে। তাছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি দেওয়ানি মামলার রায়ও হয়েছে।
সেখানেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই সামাজিক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। আসামিরা হয়রানির আশঙ্কা থেকে উচ্চ আদালতে আগাম জামিন নিতে আবেদন করেছেন।
উত্তরে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, শুধু অনুমানই নয়, অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন অনুসারে অর্থ পাচারের চেষ্টা করাও অপরাধ। তাছাড়া এ আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে অর্থনৈতিক অপরাধ (ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম) করেছেন।
এখানে অপরাধকে বিচ্ছিন্নভাবে বা ব্যক্তি হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। আসামিদের সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা করে জামিন না দেওয়ার যুক্তিতে তিনি বলেন, এ দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের বিচার হয়েছে। সামাজিক মর্যাদায় এ আসামিরা কি আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন?
হয়রানির আশঙ্কা থেকে আগাম জামিনের আবেদনের পালটা যুক্তিতে দুদক আইনজীবী বলেন, আসামিপক্ষ এখানে পুলিশি হয়রানির কথা বলেছেন। দুদকের মামলায় তারা পুলিশ পেলেন কোথায়? দুদকের মামলায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বলতে কিছু নেই।
দুদকের যে কর্মকর্তা মামলা করেছেন, তিনি কি আসামিদের বাসায় গিয়ে কখনো রেইড দিয়েছেন? কখনো হুমকি দিয়েছেন? সেটা যদি না হয়ে থাকে, তাহলে হয়রানির কথা আসছে কোথা থেকে?
আগাম জামিনসংক্রান্ত আপিল বিভাগের গাইডলাইন উল্লেখ করে এ আইনজীবী আরও বলেন, আপিল বিভাগের গাইডলাইন অনুসারে তাদের আগাম জামিনের আবেদনটিই গ্রহণযোগ্য (মেইনটেনেবল) নয়।
তাই আবেদনগুলো সরাসরি খারিজ করে তাদের হেফাজতে (কাস্টডিতে) পাঠানো হোক। এর পক্ষে মঙ্গলবার ১৭৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের মালিক এরশাদ আলীকে হেফাজতে পাঠানোর উদাহরণ টানেন দুদক আইনজীবী।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন শুনানিতে বলেন, আসামিপক্ষ একটি দেওয়ানি মামলার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু মামলাটির রায় দেওয়া হয়েছে ২০১৮ সালে। আর এ ট্রাস্টি বোর্ড জমি কেনা সম্পন্ন করেছে ২০১৬ সালে।
সুতরাং হাইকোর্টের ওই রায় আসামিদের জামিন আবেদনের পক্ষে সঙ্গত হতে পারে না। তাছাড়া অন্য এক মামলায় জামিন আবেদনকারী এক আসামির (মোহাম্মদ শাহজাহান) ওপর বিদেশযাত্রায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে।
আর্থিক অপরাধের ক্ষেত্রে জামিনের বিষয়ে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, কোনো আসামি যদি আর্থিক অপরাধে জড়িত থাকেন তাহলে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জামিন বিবেচনার ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা। তাই এ আসামিদের জামিন আবেদন সরাসরি খারিজ করে হেফাজতে পাঠানো হোক।
দুদকের উপ-পরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী বাদী হয়ে করা এ মামলায় ট্রাস্টি বোর্ডের ওই চার সদস্য ছাড়াও চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ এবং আশালয় হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন হিলালীকে আসামি করা হয়।
এজাহারে বলা হয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের অনুমোদন, সম্মতির মাধ্যমে ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯০৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির দাম ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা বেশি দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে তারা প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন।
পরে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করেন। সেই টাকা আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন এবং পরে নিজেরা উক্ত এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকেলস (রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।