
প্রিন্ট: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২০ এএম
বিনা টিকিটে ট্রেনভ্রমণ
সেই তিন যাত্রী রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়
আমার আত্মীয় নয় : সুজন * রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান টিআইবির * তদন্ত কমিটি গঠন টিটিইকে তলব

যুগান্তর প্রতিবেদন ও ঈশ্বরদী প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ মে ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাভেলিং টিকিট এগজামিনারকে (টিটিই) বরখাস্ত করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এরই মধ্যে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে। সেই কমিটি বরখাস্ত হওয়া টিটিই শফিকুল ইসলামকে আজ তলব করেছে।
বিনা টিকিটে ভ্রমণের দায়ে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়কে জরিমানা করায় টিটিই বরখাস্তের ঘটনাকে ন্যক্কারজনক দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি এ ঘটনায় রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে।
তবে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন শনিবার গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। বিনা টিকিটে ভ্রমণ করা যেমন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তেমনি যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার বা জোর করে অর্থ আদায় করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় এবং অতিরিক্ত টাকা নিয়ে টিকিট না দেওয়ায় টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে ও সেই তিন যাত্রীর একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তারের বোনের ছেলে অভিযোগকারী ইমরুল কায়েস প্রান্ত। আর তার ট্রেনযাত্রার সঙ্গী হাসান ও ওমর হলেন শাম্মীর মামাতো ভাই। শাম্মীর পরামর্শেই তারা ট্রেনে উঠেছিলেন।
সূত্র জানায়, ঈশ্বরদী শহরের নূর মহল্লায় তাদের বাড়ি। ঈশ্বরদীতে বোন নিপার বাসায় ঈদ উদযাপন করেন হাসান ও ওমর। নিপার ছেলে প্রান্তকে শাম্মী নিজের সন্তানের মতো দেখেন।
হাসান জানান, আমরা ঢাকায় যাওয়ার জন্য ট্রেনের টিকিটের জন্য বুকিং অফিসে যাই। সেখানে টিকিট না পেয়ে বিষয়টি আপুকে জানাই। আপু আমাদের যাওয়ার জন্য সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে তিনটি টিকিট দেওয়ার জন্য দায়িত্বরত গার্ড শরিফুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে বলেন।
এরপর আমরা ট্রেনের একটি বগিতে উঠি। এর কিছুক্ষণ পরই টিটিই শফিকুল ইসলাম এসে আমাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। প্রান্ত জানান, আমি ঢাকায় একটি টেক্সটাইল মিলে চাকরি করি। ছুটি শেষ হওয়ায় ঢাকায় আমাকে যেতেই হবে। টিকিট না পেয়ে ট্রেনে উঠেছিলাম।
টিটিইকে দেখেই আমি টিকিট চেয়েছি। টিটিই টাকা নিয়ে টিকিট লাগবে না বলে জানান। কিন্তু আমি টিকিট চাওয়ায় তিনি অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন। এমনকি ট্রেন থেকে লাথি দিয়ে ফেলে দিতে চান। তাকে আমার মাদকাসক্ত মনে হয়েছে।
তার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে বিষয়টি রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে জানিয়েছি। এখন বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আমাদের রেলমন্ত্রীর আত্মীয় হিসাবে জড়িয়ে নানারকম মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
এদিকে রেলমন্ত্রী বলেন, ওই টিটিইর বিরুদ্ধে রেল কর্মকর্তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না। বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। নাম ভাঙিয়ে কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
রেলসেবা বাড়াতে সরকার কাজ করছে উল্লেখ করে সুজন বলেন, বিনা টিকিটের যাত্রী মন্ত্রীর আত্মীয় হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে টিটিইরা বিভিন্নভাবে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন, বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন।
এমন অভিযোগ আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। তবে লোকবল সংকটে আমরা এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে একেবারেই ছাড় দিলে রেলের দুর্নাম হয়ে যায়। তাই যাত্রীদের সঙ্গে বেশি খারাপ আচরণ করায় টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই ওই টিটিইর বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
টিটিই শফিকুল ইসলামকে তলব : পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী পরিবহণ কর্মকর্তা (এটিও) সাজেদুল ইসলামকে প্রধান এবং সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) শিপন আলী ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী কমান্ডেন্ট (এসিআরএনবি) আবু হেনা মোস্তফা কামালকে সদস্য করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি শুক্রবার রাতে গঠন করা হয়।
শনিবার পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার যুগান্তরকে জানান, তদন্ত কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান সাজেদুল ইসলাম জানান, রোববার সরেজমিন তদন্ত করা হবে। এ সময় টিটিই, গার্ড, বিনা টিকিটধারী তিন ট্রেনযাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বক্তব্য নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, সাময়িক বরখাস্ত টিটিই শফিকুল ইসলামকে তলব করেছে তদন্ত কমিটি। পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে হাজির হতে তাকে শনিবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আজ তিনি সেখানে হাজির হয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানাবেন।
টিটিই শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, বিনা টিকিটে ভ্রমণকারী তিন যাত্রীর কাছে টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। তখন তিনি তাদের জরিমানা ও সুলভের ভাড়া বাবদ মোট ১ হাজার ৫০ টাকা নিয়ে এসি কামরা ছাড়তে বলেন।
বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে ওই তিন যাত্রীর কথা কাটাকাটি হয়। এরপর তারা এসি কামরা ছেড়ে শোভন কামরাতে ঢাকায় পৌঁছান। কিছুক্ষণ পরই মোবাইল ফোনে তাকে সাময়িক বরখাস্তের কথা জানানো হয়। সূত্র জানায়, তিন যাত্রীর একজন ইমরুল কায়েস প্রান্ত লিখিতভাবে অভিযোগ করেন।
অভিযোগপত্রে তিনি জানান, টিটিই শফিকুল তাদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন। ঢাকায় যাওয়া জরুরি হওয়ায় কাউন্টারে টিকিট না পেয়েও তারা ট্রেনে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। তাড়াহুড়ো থাকায় তারা এসি কামরায় উঠে পড়েন।
বুধবার রাতে খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে জরিমানার ঘটনা ঘটে। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকালে ঈশ্বরদীর পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও) নাসির উদ্দিনের নির্দেশে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত টিটিই শফিকুলকে রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদীর টিটিই হেডকোয়ার্টারে যুক্ত করা হয়েছে।
রেলমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান টিআইবির : টিআইবি বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানায়, এ ধরনের ঘটনা গভীর উদ্বেগ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
এর ফলে দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার বার্তা-শুধু ক্ষমতাশালীরাই নন, তাদের প্রভাব বলয়ে থাকা আত্মীয়দের জন্যও আইন প্রযোজ্য হবে না। সংস্থাটি মনে করে নৈতিক অবস্থান থাকলে এ ঘটনায় রেলমন্ত্রীর সাময়িক সময়ের জন্য পদত্যাগ করা উচিত।
বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ন্যায়নিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে পুরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট টিটিইকে ত্বরিতগতিতে বরখাস্ত করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়-অনিয়মের কাছে মাথানত করেই রুটি-রুজি টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায়।
তিনি বলেন, ঘটনাটি ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এখানে দুভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে। প্রথমত, রেলমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছেন, রেলের প্রচলিত আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করায় তাকে কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল ফোনে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
টিটিইকে বরখাস্তের জন্য যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগকে রেলমন্ত্রী সামনে নিয়ে এসেছেন। এর সঙ্গে একমতও হয়েছেন।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বিনা টিকিটের সেসব যাত্রী টিটিইকে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় কেন দিয়েছিলেন তাদের সত্যিকার পরিচয় রেল কর্তৃপক্ষ যাচাই করেছিলেন কিনা অপরদিকে যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ বিষয়ে টিটিইর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রেলমন্ত্রীর পরিচয় কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল এসব বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।