ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা
ইয়াসিন রহমান
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সমঝোতার পর বৃহস্পতিবার নিউমার্কেট এলাকার সব দোকান খোলা হয়েছে। ক্রেতা আসায় সেখানকার সবকটি দোকানে বেচা-বিক্রিও শুরু হয়েছে।
তবে ঈদ মৌসুমে মঙ্গল ও বুধবার এই দুদিন সংঘর্ষে ব্যবসায়ীদের প্রায় ৩০০ কেটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে-এমন হিসাব সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত প্রায় দুই বছর ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এটি পুষিয়ে নিতে এবারের ঈদকে সামনে রেখে নানা পণ্যের পসরা সাজানো হয়েছে। যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা। কিন্তু হঠাৎ এমন অপ্রীতিকর ঘটনায় ব্যবসায়ীদের রীতিমতো মাথায় হাত পড়েছে।
বৃহস্পতিবার নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোডের বিভিন্ন মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানিদের সঙ্গে আলাপ করে এবং সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সূত্র জানায়, এসব এলাকায় ৩৯টি মার্কেট আছে। পাশাপাশি রয়েছে একটি বড় কাঁচাবাজার। অর্থাৎ সেখানে প্রায় ১৪ হাজার দোকান রয়েছে। সংঘর্ষের কারণে কত দুদিন সব বন্ধ ছিল। এসব দোকানে প্রতিদিন ১০০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়, ফলে দুদিনে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তাছাড়া পুরো নিউমার্কেট, গাউসিয়া ও এলিফ্যান্ট রোডসংলগ্ন ফুটপাতে ছোট পুঁজির বিক্রেতারা ব্যবসা করেন। তাদের দিনে ৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ দুদিনে ১০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। সবমিলিয়ে গোটা এলাকার বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের দুদিনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ঈদ মৌসুমে ছোট একটি বিষয় নিয়ে সংঘর্ষ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সংঘর্ষে এ দুদিনে নীলক্ষেত ও এলিফ্যান্ট রোডের ব্যবসায়ীদের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
পাশাপাশি কয়েকটি দোকানে আগুন দেয়া ও ভাঙচুরের কারণে মালিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এমন অবস্থা নিরসনে বুধবার গভীর রাতে ছাত্র, ব্যবসায়ী, শিক্ষা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ঢাকা কলেজ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এক যৌথ বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে।
বৈঠকে সব পর্যায়ের সদস্য নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। সামনে যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাহলে শিক্ষার্থী শিক্ষকদের ও ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ী নেতাদের জানাবেন। তারা সমাধান করবেন। তিনি বলেন, নীলক্ষেতের দোকান কর্মচারীরা অনেকেই অশিক্ষিত। তাদের আচরণ অনেক খারাপ।
হরহামেশা তারা ক্রেতার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। এটা আমি আগেও বলেছি। এ আচরণ থেকে তাদের বিরত থাকতে হলা হয়েছে। তারা সেটা এখন থেকে মানবে। আর এ অভ্যাস সব সময়ের জন্য বহাল রাখতে কমিটির মাধ্যমে ১৫ দিন করে একটি ট্রেনিং দেওয়া হবে। ভাগে ভাগে এই ট্রেনিংয়ে (প্রশিক্ষণ) সব ব্যবসায়ী ও কর্মচারী অংশ নেবেন। তিনি আরও বলেন, আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো সুষ্ঠু ভাবে ব্যবসা করতে চাই। আইনের মধ্যে থেকে ব্যবসা পরিচালনা করতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা আগাচ্ছি।
এদিকে বুধবার গভীর রাতে এক বৈঠকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী এবং দোকানকর্মীদের মধ্যে সমঝোতা হওয়ায় বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে নিউমার্কেটের দোকান খুলতে শুরু করে। সঙ্গে আশপাশের অন্য মার্কেটগুলোও খুলতে শুরু করে।
দুপুর ১২টার দিকে সেখানকার সবকটি মার্কেটের দোকান খোলা হয়। দুপুর নাগাদ পরিস্থিতি ভালো থাকায় ক্রেতারা আসতে থাকেন। শুরু হয় বেচাবিক্রি। বেলা সাড়ে ৩টা নাগাদ প্রত্যেকটি মার্কেটে ক্রেতার ঢল নামে। বিক্রিও বেশ জমে ওঠে। সেখানে প্রত্যেকটি পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন ছিল।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, রাতে ছাত্র-ব্যবসায়ীদের বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে। তাই বৃহস্পতিবার থেকে মার্কেট খোলা হয়েছে।
বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে ভরা ঈদ মৌসুমের এই দুদিনে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সব মার্কেট বন্ধ ছিল। দোকান খোলা যায়নি। যে কারণে দিনে এখানকার ব্যবসায়ীদের ১০০ থেকে দেড়শ কোটি টাকার উপরে ক্ষতি হয়েছে।
চাঁদনিচক মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী মো. শাকিল বলেন, ঈদ মৌসুমে আমরা কোনো সংঘাত চাই না। গত ২ বছর ঈদ মৌসুমে করোনার কারণে ব্যবসা ভালো হয়নি। এবার আল্লাহর রহমতে অবস্থা ভালো থাকায় প্রথম রোজা থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে। মাঝে কে বা কারা এমন সংঘাত তৈরি করল জানি না। আমরা সেই সংঘাতে নামিনি। দোকানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য দোকানের পাশে অবস্থান নিয়েছি। এমন অবস্থায় ঈদ মৌসুমের এই দুদিনে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। যা পূরণ হবে না। তারপরও আমরা উঠেপড়ে নেমেছি।
গ্লোব শপিং সেন্টারের নিচ তলায় প্যান্টের ব্যবসায়ী মো. আল আমিন হক বলেন, রোজার শুরু থেকে এবার বিক্রি জমেছে। কিন্তু এই দুদিন সংঘাতে দোকান বন্ধ ছিল। বিক্রি হয়নি। তাতে আমরা ঈদ মৌসুমে বিক্রিতে পিছিয়ে গেলাম। লোকসান না হলেও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। কারণ দুই বছর ঈদের বাজার ধরতে পারিনি। এবার প্রতিদিনের বাজার ধরতে না পারলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
একই মার্কেটের প্যান্ট কাটিং কারিগর মো. জুয়েল বলেন, রোজায় প্রতিদিন ৫০টি প্যান্ট কাটার টার্গেট নেই। এবারও সেই টার্গেট নিয়ে কাজ করছি। প্রতি প্যান্ট ৫০ টাকা করে লম্বায় কাটালেও ৫০ পিসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা আসে।
পাশাপাশি শার্ট ও প্যান্টের কোমরের ফিটিং করাতে দিনে আরও দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের এ মারামারিতে দুদিন কোনো কাজ হয়নি। মেশিনের চাকা না ঘুরলে আমাদের ইনকাম নেই। এই দুদিন বসে লোকসান গুনতে হয়েছে।
জহির এসি মার্কেটের ঠাকুরগাঁও বেল্ট ও ঘড়ি কর্নারের মালিক মো. মিলন মিয়া বলেন, ঈদ ঘিরে রোজায় দিনে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। কিন্তু এই দুদিন বিক্রি নেই। তবে আজ (বৃহস্পতিবার) দোকান খুললেও বিক্রি তেমন হয়নি। সব মিলে দুদিনের লোকসান পূরণ হবে না।
সোমবার রাত ১২টার দিকে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। পরদিন মঙ্গলবার সকালে আবারও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীরা। থেমে থেমে সারা দিন চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। বুধবারও একই চিত্র ছিল।