রমজান-বৈশাখ-ঈদুল ফিতর
উৎসবে চাঙা অর্থনীতি
অতিরিক্ত লেনদেন হবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা * করোনার পর ব্যবসায়ীদের স্বস্তি
মনির হোসেন
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
যমুনা ফিউচার পার্কে জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। মঙ্গলবারের তোলা ছবি: যুগান্তর
করোনায় টানা দুই বছরের স্থবিরতার পর দেশের অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে বইছে উৎসবের আমেজ। রমজান, পহেলা বৈশাখ এবং ঈদুলফিতরের কারণে চাঙা হয়ে উঠেছে অর্থনীতি। বাজারে বেড়েছে টাকার প্রবাহ। উৎসবের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।
তবে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হিসাব বলছে, চলতি মাসেই অর্থনীতিতে অতিরিক্ত আরও দেড় লাখ কোটি টাকা লেনদেন হবে। খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহণ খাতে এই বাড়তি অর্থ যোগ হচ্ছে।
পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবী, দোকান কর্মচারী, পোশাক ও বস্ত্র খাতের শ্রমিকসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবীদের বোনাসও এই কর্মকাণ্ডে যোগ হবে। এর প্রভাবে ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত শপিংমল পর্যন্ত বেড়েছে বেচাকেনা।
কেনাকাটা বেড়েছে অনলাইনেও। জমে উঠেছে ইফতারির বাজার। গ্রামেও টাকার প্রবাহ বাড়ছে। সবকিছু মিলে উৎসবে চাঙা হয়ে উঠছে অর্থনীতি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঘন ঘন হাতবদল হওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন বাড়ে, তেমনইভাবে বাড়ে সরকারের রাজস্ব আয়ও। তাদের মতে, অর্থনীতিতে চাহিদা বেড়েছে। এর সঙ্গে সরবরাহ ঠিক রাখতে না পারলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা আছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, করোনার কারণে দুই বছর বাজার স্থবির ছিল। এবার একসঙ্গে তিন উৎসব।
অর্থনীতিতে এর একটি ইতিবাচক দিক রয়েছে। কারণ এতে দেশে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঠিক রাখতে পারলে এই উৎসব পুরোটাই ইতিবাচক বলা যায়।
মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, সরকারি চাকরিজীবী এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও বোনাস দিচ্ছে। বাজারে এই বাড়তি টাকা আসায় কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। এতে অভ্যন্তরীণ একটি চাহিদা সৃষ্টি হবে। তবে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়তে পারে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের হিসাবে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার হচ্ছে ৩২ লাখ কোটি টাকা। তবে উৎসবে কত টাকা লেনদেন হয়, এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব নেই।
রোজা ও ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআই-এর সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হেলাল উদ্দিন নিজস্ব একটি সমীক্ষা করেছেন। ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, রোজা ও ঈদে অতিরিক্ত ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন যোগ হচ্ছে।
সমীক্ষা মতে, পোশাকের বাজারে যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। নিত্যপণ্যের বাজারে বাড়তি যোগ হচ্ছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। জাকাত ও ফিতরা বাবদ আসছে ৬৭ হাজার কোটি টাকা। পরিবহণ খাতে ৮০০ কোটি টাকা।
ঈদকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ ও বিনোদন বাবদ ব্যয় হয় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও কয়েকটি খাতের কর্মকাণ্ডে টাকার প্রবাহ বাড়বে।
এর মধ্যে রয়েছে ১৪ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, ৬০ লাখ দোকান কর্মচারী এবং তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের বোনাস-যা ঈদ অর্থনীতিতে আসছে।
এছাড়া রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকা। মার্চে ১৮৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ধারণা করছে, এপ্রিলে তা ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অঙ্কে যা ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
জানা যায়, তিন উৎসবের শুরুতেই রমজান। এই মাসে মানুষের পণ্য চাহিদা বাড়ে। বিশেষ করে ইফতারে ব্যবহার হয়, এ ধরনের পণ্যগুলোর চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এর মধ্যে রয়েছে ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর, পেঁয়াজ, চিনি, ডাল, ডিম, ফলমূল, শাকসবজিসহ অন্যান্য আইটেম। রমজানে সারা দেশে ইফতারকেন্দ্রিক কয়েক লাখ মানুষ মৌসুমি ব্যবসা করে।
করোনার কারণে গত দুই বছর এই প্রবণতা কম ছিল। কিন্তু এবার তা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
দ্বিতীয় উৎসবের মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব এটি। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে এই একটি দিনে সবাই যেন বাঙালী হয়ে যায়। বৈশাখের অর্থনীতির সুনির্দিষ্ট আকার নিয়ে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গবেষণা হয়নি।
তবে সূত্রের হিসাবে লেনদেনের সম্ভাব্য পরিমাণ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। উৎসবের জন্য সরকার এ বছরও বোনাস দিয়েছে। আগের দুই বছর করোনায় বৈশাখের উৎসব সেভাবে পালন হয়নি।
কিন্তু করোনা না থাকলেও রমজানের কারণে বৈশাখের মূল উৎসব পান্তা-ইলিশসহ দিনের খাওয়া বন্ধ থাকবে। তবে পোশাকের বাজারসহ অন্যান্য কমর্কাণ্ড চলবে। ফলে ইতোমধ্যে বৈশাখের হাওয়া লেগেছে অর্থনীতিতে।
বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক, রকমারি বাঙালি খাবার, কার্ড ও মোবাইলে শুভেচ্ছা বিতরণ, মেলা এবং হালখাতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে উৎসব। খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো বৈশাখে বিশেষ অফার দিচ্ছে।
ব্যাংকগুলো ক্রেডিট কার্ডে রয়েছে আকর্ষণীয় অফার। ফ্যাশন হাউজগুলোয় বাহারি রং ও ডিজাইনের বাঙালি পোশাকের সমারোহ। নতুন পোশাক কিনতে হাউজগুলোয় প্রতিদিনই ভিড় ভাড়ছে।
ফুটপাত থেকে শুরু করে নামিদামি শপিংমল পর্যন্ত সবখানেই বৈশাখের ছাপ পড়েছে। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন কোম্পানি বিশেষ মূল্যছাড় দিয়েছে। গত কয়েক বছরে অনলাইনে কেনাকাটায় গ্রাহকের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
এই উৎসবের মূল আকর্ষণ ইলিশ। বর্তমানে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন হিমঘরে (কোল্ড স্টোরেজ) মজুত করা ইলিশ বাজারজাত শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। পিছিয়ে নেই নিত্যপণ্য, ফুল, মৃৎশিল্প এবং গহনার ব্যবসায়ীরা।
গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই বৈশাখ ঘিরে জমজমাট-বাংলা নববর্ষ বরণ করতে প্রস্তুত। গ্রামগঞ্জে চলছে অসংখ্য মেলার আয়োজন। শহরের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে বৈশাখী তাঁতমেলা। এসব কর্মকাণ্ড ঘিরে অর্থনীতির লেনদেন বাড়ছে কয়েক গুণ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশাখে বেশি কেনাকাটা হয় পোশাক। বছরে যেসব কেনাকাটা হয়, এর ২০ শতাংশই বৈশাখে। দুই ঈদে মিলে ৬০ শতাংশ। বাকিটা সারা বছর। শাড়ি, পাঞ্জাবি এবং ফতুয়া বেশি বিক্রি হয়।
এশিয়ার বৃহত্তম মার্কেট যমুনা ফিউচার পার্ক ঘুরে দেখা যায়, বিপণিবিতানগুলোয় অভিজাত ও মধ্যম আয়ের ক্রেতাদের জন্য সব ধরনের বৈশাখী সাজ ও পোশাক কিনতে ব্যাপক ভিড়। ব্যস্ত নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরুমগুলো।
বিশেষ করে আড়ং, অঞ্জনস, দেশি দশ, নবরূপা, মেট্রো, জেন্টলপার্ক, ইনফিনিটি, ক্যাটস আইসহ দেশের সব শীর্র্ষ ব্র্যান্ডগুলো বৈশাখী পোশাকের পসরা সাজিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পেশাকে ৫ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রায় প্রতিটি দোকানে ঘুড়ি, মুখোশ ও লাল-নীল বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। এসব শোরুমে ক্রেতারা তাদের পছন্দসই পোশাক কিনতে ভিড় করছে। যমুনা ফিউচার পার্কে বেচাকেনায় আমেজ চলছে।
মেয়েদের জন্য রং-বেরঙের থ্রি-পিস, কুর্তি, শাড়ি ও ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবি, ফতুয়া বেশি বিক্রি হয়। আর শিশুদের জন্যও রয়েছে দারুণ সংগ্রহ। আর গতবারের তুলনায় এবার পোশাকের দাম বেশি হবে না। সবকিছু মিলে বৈশাখকে ঘিরে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন গতি এসেছে।
বৈশাখের পরেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুলফিতর। ঈদে স্বাভাবিকভাবেই টাকার প্রবাহ বাড়ে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, ব্যবসার টাকা, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ এবং জাকাত-ফিতরা মিলিয়ে অর্থনীতিতে নতুন করে দেড় লাখ টাকা যোগ হয়।
এর একটি অংশ ইতোমধ্যে গ্রামে চলে গেছে। ঈদ ও রোজার বাড়তি খরচ মেটাতে কৃষকের ঘরে মজুত ধান বা অন্যান্য ফসলের একটি অংশ বিক্রি শুরু হয়েছে। তরমুজের মতো মৌসুমি ফলের ব্যবসাও জমে উঠে এসেছে।
এছাড়াও অর্থবছর শেষ হয়ে আসায় সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ খরচ করার ধুম পড়েছে। ফলে সবকিছু মিলে টাকার স্রোত এবার গ্রামের দিকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই টাকার বড় অংশই যাচ্ছে ভোগবিলাসে।
আর কিছু অংশ যাচ্ছে গ্রামের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্পভিত্তিক উৎপাদন খাতে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী বলেন, রোজার ঈদে টাকার প্রবাহ সবচেয়ে বেশি বাড়ে।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই টাকা পোশাক, ভোগ্যপণ্য, শৌখিনতা, ভ্রমণসহ বিনোদনমুখী খাতে বেশি হচ্ছে। কাজেই এটা একটা বড় ভূমিকা রাখে অর্থনীতিতে। তিনি আরও বলেন, উৎসব অর্থনীতির আকার, ধরন ও ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে।
মানুষ এই উৎসব ঘিরে প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করেন। এতে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী প্রত্যেকে কিছু না কিছু লাভবান হচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
জানা যায়, অতিরিক্ত চাহিদা পূরণে এবার বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। এগুলো এখন তা খুচরা বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে। ঈদুলফিতরে বেশি অর্থব্যয় হয় নতুন পোশাক ক্রয়ে।
মার্কেটগুলোয় সব বয়সি মানুষের চাহিদা অনুযায়ী পোশাক বেচাকেনা হচ্ছে। এসময় অভ্যন্তরীণ পোশাকে চাহিদা বাড়ে ব্যাপক হারে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ধারণা-করোনার পর এবার ব্যবসা জমে উঠবে।
তবে এখনো আশা অনুসারে সাড়া আসেনি। কিন্তু এখনো সময় আছে। আশা করছি, আগামী দিনে বেচাকেনা আরও বাড়বে।