পিছিয়ে গেল জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ
দর ফাঁস, ৩৪৪ কোটি টাকার দরপত্র বাতিল
নেপথ্যে সরকারি দলের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রাক্কলিত গোপন দর ফাঁস করে দেওয়ার ঘটনায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুরুতেই হোঁচট খেল। আটকে গেল রাজধানী ঢাকার চারপাশে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। যোগসাজশের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ১৪টি লটের মধ্যে ১২টি লটের দরপত্র বাতিল করেছে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়।
৩০ কোটি টাকার কম হওয়ায় অবশিষ্ট ২টি লটের কাজ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবে এই লটের মধ্যেও একই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ’র একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছে, নতুন করে দরপত্র আহ্বান করায় এখন প্রকল্পের সময় ও খরচ দুটিই বাড়বে। বিদ্যমান এক হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ টাকার প্রকল্প ব্যয় ১২শ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।
এজন্য এর পেছনে যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির দাবি করেন কেউ কেউ। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার পেছনে সরকারি দলের প্রভাবশালী লোকজন জড়িত।
যারা নথিতে নিয়ম-কানুন ঠিক রেখে যারা কয়েকশ কোটি টাকার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে চেয়েছিল। এজন্য দরপত্র নিশ্চিত করতে মহলবিশেষ আগেই তাদের প্রাক্কলিত গোপন দরের তথ্য সরবরাহ করে। এ বিষয়ে অভিযোগের তীর বিআইডব্লিটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিকে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘দরপত্র প্রক্রিয়ায় ভুল থাকা ও সব প্রতিষ্ঠানের সমান সুযোগ না থাকায় দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি বলেন, দরপত্রে প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল। স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট (এসটিডি) অনুযায়ী না হওয়া এবং সব ঠিকাদারের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ না থাকায় টেন্ডারগুলো অনুমোদন করা হয়নি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে- তাদের উদ্ধৃত দর একই ধরনের ছিল, যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছি। সামনের টেন্ডার প্রক্রিয়া দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক যুগান্তরকে বলেন, ‘যদি প্রাক্কলিত দর ঠিকাদারের কাছে প্রকাশ হয়ে থাকে তাহলে তা অন্যায় হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ এলে খতিয়ে দেখা হবে।’
তিনি বলেন, ‘নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া ও কাজ বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ প্রকল্পে ভালো ঠিকাদার আসতে চান না। এতেও প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি কমছে।’
প্রসঙ্গত, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ (২য় পর্যায়) নামে পরিচিত’।
২০১৮ সালের জুনে প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ওই সময়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। পরে নতুন কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে সংশোধন করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১৮১ কোটি ১০ লাখ টাকা। মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মোটা দাগে দুটি কারণে ১২টি টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, প্রতিটি লটেই যেসব ঠিকাদারদের নিয়োগে বিআইডব্লিউটিএ সুপারিশ করেছে, সেসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট টেন্ডারের প্রাক্কলিত গোপন দরের সঙ্গে মিল রেখে ১০ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করেছে।
এতে টাকার সঙ্গে পয়সাও পর্যন্ত মিলে গেছে। এভাবে দর মিলে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করে বিআইডব্লিউটিএর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
দ্বিতীয়ত, এই কাজের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্ট (এসটিডি) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি কার্যাদেশে ৫০-৭০ শতাংশ কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার নিয়ম রয়েছে।
কিন্তু টেন্ডারের শর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা শিথিল করে দুটি কার্যাদেশ মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট কাজের ৫০ শতাংশ অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। এভাবে শর্ত শিথিল করে দেওয়া এসটিডি পরিপন্থি বলে উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ন্যাশনাল ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট (ই-জিপি) পদ্ধতিতে এসব টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। টেন্ডার আহ্বান থেকে তা বাতিল হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় গেছে প্রায় পাঁচ মাস।
যে ১২টি লটের ঠিকাদারদের নিয়োগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, তাদের সবাই বিআইডব্লিউটিএর প্রাক্কলিত দরের সঙ্গে হুবহু মিল রেখে ১০ শতাংশ কম দর দিয়েছে।
এর মধ্যে একটি লটে আশুলিয়া থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত তুরাগ নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে ও আনুষঙ্গিক কাজের গোপন প্রাক্কলিত দর ছিল ২৯ কোটি ৪৭ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩০ টাকা ১৫ পয়সা।
এর হুবহু ১০ শতাংশ কম হিসাবে ২৬ কোটি ৫২ লাখ ৬১ হাজার ৯৭৭ টাকা ১৩ পয়সা দর দিয়েছে যৌথভাবে নিয়াজ ট্রেডার্স ও খান ট্রেডার্স।
একইভাবে রাজধানীর আমিনবাজার থেকে ইস্টার্ন হাউজিং পর্যন্ত ওয়াকওয়ে ও সংশ্লিষ্ট কাজের প্রাক্কলিত দর ছিল ২৪ কোটি ৬৮ লাখ ৯৫ হাজার ২২৫ টাকা ৭৫ পয়সা।
এ টেন্ডারে যৌথভাবে ডন করপোরেশন, এম আর কনস্ট্রাকশন ও এসকে ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে ২২ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৭০৩ টাকা ১৭ পয়সা দর প্রস্তাব করেছে।
এখানে প্রাক্কলিত দরের হুবহু ১০ শতাংশ কম দর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রকৌশলী জানান, প্রাক্কলিত দর গোপন রাখার নিয়ম। সেটা পছন্দের ঠিকাদারকে জানিয়ে দেওয়া হলেই কেবল এভাবে মিলিয়ে দর প্রস্তাব করা সম্ভব।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলেন এ সংস্থার তিনজন কর্মকর্তা। তারা হলেন- তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মো. নূরুল আলম (বর্তমানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব), বর্তমান উপপরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউল ইসলাম এবং অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এএইচএম ফরহাদউজ্জামান।
এভাবে দর মিলে যাওয়া ও ঠিকাদারের যোগ্যতা শিথিল করার বিষয়টি দরপত্র মূল্যায়নে বিবেচনা করা হয়েছিল কিনা-জানতে চাইলে উপপ্রকল্প পরিচালক মতিউল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক টেন্ডারের নোটিশ দিয়েছেন। ওই নোটিশে যে যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে সেই অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে প্রাক্কলিত দর ঠিকাদাররা পেয়েছেন কিনা, পেলে কীভাবে পেয়েছেন তা আমি জানি না।’
এদিকে ১২টি লটের ঠিকাদার নিয়োগ টেন্ডার বাতিল হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ২৭ কোটি টাকা ফেরত গেছে।
এখন নতুন টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতেই চলতি বছরের বাকি সময় চলে যাবে। এছাড়া সামনে বর্ষা মৌসুম শুরু হলে তখন কাজ করা সম্ভব হবে না।
এসব কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় আরও এক বছর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় আবারও বাড়তে পারে। আরও জানা গেছে, এর আগেও এ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল।
ওই প্রক্রিয়ায় যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে সঠিকভাবে কাজ করতে না পারার অভিযোগ রয়েছে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের কাছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি সভায় গত মার্চ পর্যন্ত এ প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৩২ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
ওই সময় পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ছিল প্রায় ২২০ কোটি টাকা। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতেই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নদীর তীরে বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ।