নির্মাণসামগ্রীর দাম চড়া, উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি
বাড়ছে প্রকল্প ব্যয় * অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে * কমবে প্রবৃদ্ধি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এরমধ্যে রড, সিমেন্ট, ইট এবং বালু অন্যতম। ফলে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, ব্যক্তিগত ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং আবাসন ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। পুরো শিল্পে স্থবিরতা চলছে। রড ও সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বলছে তিনটি কারণে এই দাম বৃদ্ধি। এগুলো হলো- ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং করোনার পর নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ায় পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি।
এক্ষেত্রে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিদেশ থেকে রড আমদানির অনুমতি চেয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রবৃদ্ধি কমবে। সরকারের প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। তবে এ দাম বৃদ্ধি সাময়িক সময়ের জন্য। অদূর ভবিষ্যতে এসব পণ্যের দাম কমে আসবে।
আবাসন মালিকদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর সামসুল আলামিন বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির প্রভাব সরাসরি আবাসন খাতে পড়েছে। দীর্ঘদিন পর ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। কিন্তু এ সময়ে দাম বৃদ্ধির ফলে আবাসন খাত বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
তিনি বলেন, আবাসন খাতের বৈশিষ্ট্য হলো সাধারণত নির্মাণের আগেই ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়। তাই হঠাৎ করে সবকিছুর দাম বাড়ায় সামনে ফ্ল্যাটের দামও বাড়াতে বাধ্য হব। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা দুপক্ষই ক্ষতির মুখে পড়বে।
জানা যায়, নির্মাণকাজের অন্যতম প্রধান উপকরণ রডের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। খুচরা বাজারে প্রতি টন ভালো মানের (৬০ গ্রেডের উপরে) রড এখন প্রায় ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগেও যা ছিল ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এক বছরের ব্যবধানে ঘরবাড়ি ও স্থাপনা নির্মাণের প্রধান এ উপকরণের দাম প্রতি টনে বেড়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা। অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে কাঁচামাল সংকটকে প্রধান কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বিশ্ববাজারে এখন বেশি।
গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি দামে এই মেটাল কিনতে হচ্ছে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে-স্টিলনির্ভর যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণে রডের দরকার হয় ২৫ ভাগ। আর এ রডের দাম ২৫ ভাগ বাড়লে পুরো প্রকল্পের ব্যয় ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাড়বে। এদিকে নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম অনুষঙ্গ রডের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরাও। ইতোমধ্যে এ খাতের ব্যবসায়ীরা রডের দাম নিয়ন্ত্রণে আগামী বাজেটে কর ও ভ্যাট কমানোর দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি মানোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামাল ও রাসায়নিকের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও রডের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। তাতে দামও বাড়ছে। রডের দাম নিয়ন্ত্রণে আগামী বাজেটে কর ও ভ্যাট কমানো জরুরি।
জানা যায়, প্রতিবছর দেশে রডের চাহিদা ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। প্রতি মাসে সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টন। এসব রড তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসাবে পুরোনো লোহার টুকরা আমদানি করা হয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় জাহাজভাঙা শিল্প ও স্থানীয় ভাঙারি বর্জ্য থেকে।
দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানার সংখ্যা ৩০টি। আর সনাতনী পদ্ধতির কারখানা প্রায় ১০০টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রডের দাম বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিছুদিন আগেও ৪৫০ ডলারে কেনা যেত। এখন সেটি প্রায় ৭শ ডলার।
এছাড়া কারখানায় গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উন্নয়ন কাজের জন্য রডের চাহিদা অনেক বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে তা প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে।
রডের পাশাপাশি বেড়েছে অন্যতম নির্মাণ উপকরণ সিমেন্টের দাম। এক মাস আগেও প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৩৯০ টাকার মধ্যে। বর্তমানে তা ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর কবির যুগান্তরকে বলেন, সিমেন্ট উৎপাদনে যতগুলো কাঁচামাল প্রয়োজন, তার সবই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এরমধ্যে চুনা পাথর, স্লাগ লাইমস্টোন, ফ্লাই অ্যাশ এবং জিপসাম অন্যতম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সমুদ্রগামী জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। এতে আমদানি পণ্যের খরচ বেড়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছোট-বড় মিলিয় প্রায় ৩৬টি কোম্পানি উৎপাদনে রয়েছে। পণ্যের চাহিদা বার্ষিক ৩ কোটি ৭০ লাখ টন। বিপরীতে উৎপাদন সক্ষমতা ৮ কোটি ৬০ লাখ টন। অর্থাৎ দেশে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি। তাই প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা থাকায় কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত মুনাফা করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এখাতে আমদানি পর্যায়ে সরকার ৩ শতাংশ এআইটি বা অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স নেয়। এটি যৌক্তিক নয়। এমনিতেই আমদানি শুল্ক বেশি।
এরপর ভ্যাটের হারও বেশি। অর্থাৎ দুটো মিলে প্রায় ২৫ শতাংশ, অন্য কোনো কাঁচামালের ওপর দেখা যায় না। এআইটি প্রত্যাহার করা হলে ব্যাগ প্রতি ন্যূনতম ১৫ টাকা কমানো সম্ভব।
অন্যদিকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ইটের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ভালোমানের (১ নম্বর) প্রতি হাজার ইটের দাম ১৩ হাজার টাকা। কিন্তু এক মাস আগেও যা ছিল ৯ হাজার টাকা। দ্বিতীয় গ্রেডের ইট বিক্রি হচ্ছে ১১ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায়। অথচ ভালোমানের ইট এর আগে সাড়ে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যেই বিক্রি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়লা সিন্ডিকেটের কারণে ইটের দাম বেড়েছে। এক টন কয়লা ছিল সাত হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে ১৪ হাজার টাকার বেশি।
এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মাইশা কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী মো. পারভেজ বলেন, সরকারি সংস্থার নির্মাণসামগ্রীর মূল্য তালিকায় রডের টন প্রতি দাম ধরা আছে ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাস্তবে রডের টন প্রতি দাম প্রায় ৯০ হাজার টাকা।
এ অবস্থায় নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছি আমরা। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করে মূল্য তালিকায় রডের দাম বাজার মূল্য অনুযায়ী নির্ধারণ করা বা কাজের পরিধি কমিয়ে দেওয়া ছাড়া এসব কাজ করা কোনো ঠিকাদারের পক্ষে সম্ভব নয়।
করোনার স্থবিরতা কাটিয়ে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আবারও পুরোদমে শুরু হয়েছে। পাশাপাশি নির্মাণ মৌসুম হওয়ায় এখন শহর-গ্রামে ভবন নির্মাণ বেড়েছে। তাই বাজারে এখন নির্মাণসামগ্রীর চাহিদাও বাড়ছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণকারী ও আবাসন ব্যবসায়ীরা।
নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় এর প্রভাব পড়েছে আবাসন ব্যবসায়ের পাশাপাশি বড় বড় ঠিকাদারি কাজে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের নির্মাণশিল্পে ভাটা দেখা দিয়েছে। ফলে নির্মাণশিল্পের সঙ্গে জড়িত সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর, হার্ডওয়্যার, টাইলস ফ্যাক্টরিগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ সমস্যা পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এতে এ শিল্পে জড়িত বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার প্রায় ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবমিলে দেশে এক অর্থনৈতিক মহামারি সৃষ্টি হবে।
কয়েক মাস আগে নির্মাণ ও অবকাঠামো খাতের মূল কাঁচামালের দাম বৃদ্ধিতে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। এ পরিস্থিতিতে প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয় সামাল দিতে রড আমদানির অনুমতি চেয়েছে ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ সংগঠনটি। একইসঙ্গে সরকারি নীতিমালার কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়লে ঠিকাদারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধানের অনুরোধ জানিয়েছে এফবিসিসিআই।
প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া সভাপতি জসিম উদ্দিনের চিঠিতে দেশের নির্মাণসংশ্লিষ্ট পণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধ ও নির্মাণ খাতে চলমান অস্থিরতা নিরসনে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
ঠিকাদারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন-বাসির সভাপতি প্রকৌশলী এসএম খোরশেদ আলম জানান, রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম হঠাৎ বাড়তে থাকায় চলমান কাজ সময়মতো শেষ করা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন তারা। এরই মধ্যে কাজে ধীরগতি নেমে এসেছে। কারণ, তারা যখন টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন সেখানে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে শঙ্কায় বর্ধিত মূল্য নির্ধারণের সুযোগ ছিল না। অথচ এখন বর্ধিত দামে কিনতে হচ্ছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ১ হাজার ৫৯১টি প্রকল্প রয়েছে। এরমধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ৩৭২, কারিগরি সহায়তা ১২০, উন্নয়ন সহায়তা থেকে ৯ এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ৯০টি প্রকল্প রয়েছে। আর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এডিপি থেকে ৮৪ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। যা মোট এডিপির ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান রড-সিমেন্টের দাম যেভাবে বাড়ছে, তা দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে ব্যয় বাড়বে। এছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।