Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

গুণী উপাচার্য নিয়োগে বাধা রাজনীতির প্রভাব

Icon

মুসতাক আহমদ

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গুণী উপাচার্য নিয়োগে বাধা রাজনীতির প্রভাব

দেশের তিন বরেণ্য শিক্ষাবিদ বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা নতুন নয়। সমস্যাটা দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই এর সূচনা। ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারের যাত্রার পর তা প্রকট হতে শুরু করে। আর বর্তমানে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। তবে এই অবস্থার আশু উন্নতি দরকার। আর তা একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে ও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অর্জন সম্ভব।

তারা আরও বলেন, বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে চান না-এটা ঢালাও বক্তব্য। সম্মান আর শিক্ষার কারণেই উপাচার্য হওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ থাকে। কিন্তু এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সেটা নেই। চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। আইন পরিবর্তন করে সুনির্দিষ্ট গুণাবলির আলোকে শিক্ষকদের মাধ্যমে গঠিত বাছাই কমিটি উপযুক্ত উপাচার্য খুঁজে বের করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বাধা রাজনীতির প্রভাব। সরকার চাইলেই এর সমাধান সম্ভব।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ ও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উপাচার্যের অনাকাক্সিক্ষত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা এবং শিক্ষার মান প্রসঙ্গে সদস্যরা আলোচনায় অবতীর্ণ হন। অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, কোনো কিছুর সুফল একটা দেশের সরকার এবং ওই দেশের আইন-কানুনের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল। কেবল আইনে লেখা থাকলেই লাভ হয় না, যদি না তার ঠিকমতো প্রয়োগ হয়। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে লক্ষ করেছি, প্রতিটি সরকার, বিশেষ করে, ১৯৭২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে তাদের দলীয় সহযোগী তৈরির চেষ্টা প্রকাশ্যভাবেই করে আসছে। রাজনৈতিক দল ছাত্র সংগঠনগুলোকেও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হতে দেয় না। এই অবস্থার মধ্যে শিক্ষকদের কেউ লোভে, আবার কেউ ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছেন। পাকিস্তানি আমলে এখানে (বিশ্ববিদ্যালয়) খাজা নাজিমুদ্দিন, নুরুল আমিন, মোনায়েম খান প্রমুখের শাসনকালেও শিক্ষকদের অবস্থা এত নিচে নামিয়ে ফেলা হয়নি। আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, আমাদের রাজনীতির নিকৃষ্টতার কারণেই এমনটি হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষের কেন্দ্রীয় প্রবণতা হলো, ধনবাদ ও ভোগবাদ। কেবল পুঁজিপতিদের কিংবা ব্যবসায়ীদের দোষ দিলে অবস্থার উন্নতি হবে না। এর জন্য নৈতিক উন্নতি দরকার। নৈতিক বিষয়কে বোঝার চিন্তা ও চেষ্টা কোনো দলের নেতৃত্বের মধ্যেই নেই।

তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক নেতৃত্বে উন্নতি দরকার। সরকার যদি সমস্যাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে না চায়, কেবল দলীয় স্বার্থে শিক্ষকদের ও শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে, তাহলে উন্নতি হবে না। উন্নতির জন্য যে নৈতিক জাগরণ দরকার তা সম্ভব হতে পারে সুধী ব্যক্তিদের দ্বারা। কিন্তু বাংলাদেশে সুশীল সমাজীদের মধ্যে সেই রকম চিন্তা-চেতনা দেখা যায় না। প্রচারমাধ্যমও অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু সে রকম প্রচারমাধ্যম আমরা খুঁজে পাই না। তার মতে, সমস্যাটা দীর্ঘস্থায়ী। বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলেও দীর্ঘ চেষ্টার মাধ্যমে ধীরগতিতে উন্নতি সম্ভব হতে পারে। তবে সবটাই নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর। জাতীয় সংসদে যেটুকু আলোচনা হয়েছে তা নিতান্তই সামান্য। সংসদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে এবং গোটা শিক্ষানীতি নিয়ে আরও গভীর আলোচনা-সমালোচনা দরকার। বিতর্কের মধ্য দিয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হতে পারে। প্রচারমাধ্যম ও সংসদে আমরা সেই গভীর চিন্তাভাবনা ও মতবিনিময় চাই। অল্পসময়ে সমস্যার সমাধান হবে না। দীর্ঘ চিন্তা ও চেষ্টা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়া পর্যন্ত উপাচার্যদের সম্পর্কে তেমন বড় অভিযোগ আসেনি। এই পদটি প্রথম কলঙ্কিত করা হয়েছে ক্ষমতায় চারদলীয় জোটের আবির্ভাবের পর। ক্ষমতায় আসার কয়েকদিনের মধ্যে ব্রিটিশ আমলের ১৮৯৯ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের মাধ্যমে রাতারাতি ১১ জন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে অপসারণ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় পরে সব জায়গায় দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে উপাচার্য বসানো হয়। যদিও স্থলাভিষিক্ত হওয়া যে পণ্ডিতজন ছিলেন না তা নয়। কিন্তু ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতি-অনিয়মে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে। তাদের বিরুদ্ধে ইউজিসির তদন্তে প্রমাণ মেলে। যে কারণে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ৭-৮ জনকে অপসারণ করা হয়। সুতরাং রাজনৈতিক সরকারের হাতে দলীয় বিবেচনায় সেই যে নিয়োগের ইতিহাস শুরু, সেটা আজও থামেনি।

তিনি বলেন, পণ্ডিতজন বা বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে চান না-এই দাবি সঠিক নয়। এটাও ঢালাও বক্তব্য। বর্তমানে সৎ ব্যক্তি উপাচার্য আছেন। আবার এমন অনেককে উপাচার্য করা হয়েছে যাদের ন্যূনতম প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের রেকর্ড নেই। আগে থেকেই সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে কিংবা প্রথম মেয়াদে বিতর্কিত কাজ করেছেন-এমন ব্যক্তিও উপাচার্য হয়েছেন, হচ্ছেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা ব্যক্তিকে কেন ইউজিসির সদস্য করা হলো। আইনে দ্বিতীয় মেয়াদে সদস্য করার বিধান না থাকা সত্ত্বেও সদস্য কে করল। তিনি মনে করেন, আইনে কী আছে সেটা দেখার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। পাশাপাশি তার অধীন প্রতিষ্ঠানে কী হয় সে ব্যাপারে খোঁজ রেখে ব্যবস্থা নিয়ে সরকার প্রধানকে সুপরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের; ভুল পরামর্শ দেওয়া নয়।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল উপাচার্য নিয়োগে আইন আছে। অন্যগুলোতে নিয়োগের কোনো নিয়ম নেই। কেবল মন্ত্রণালয় খুঁজে বের করে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ নাতির বয়সি রাজনীতিকদের কাছে গিয়ে ধরনা ধরেন। ছাত্রদের দিয়ে তদবির করানোর রেকর্ডও আছে। আমলাদের কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকায় আছেন।

তিনি মনে করেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের আইন ও ব্যবস্থা নেই, সেখানে পদ্ধতি চালু করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন সংশোধন করতে হবে। উপাচার্যের জন্য তাকেই বাছাই করা দরকার যার বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে। পাশাপাশি যার ‘একাডেমিক এক্সিলেন্স’, প্রশ্নাতীত আর্থিক সততা আছে তাদের উপাচার্য নিযুক্ত করতে হবে। তাহলেই সমস্যা সমাধান হতে পারে।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান সম্পর্কে সংসদে সদস্যদের এই আলোচনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আনন্দিত। তবে এই আলোচনা যদি কাউকে দায়ী করার পরিবর্তে আত্মসমালোচনা আর সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হয়, সেটা হবে যুগান্তকারী। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের মান অবনমনের যে কথা বলা হচ্ছে তার জন্য সব সরকারই দায়ী। এক সময় চ্যান্সেলর নিজে সাক্ষাৎকার নিতেন, যাতে দলীয় বা অনুগত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা যায়। দলীয় লোক নিয়োগের ওই ধারা থেকে পরবর্তী বিএনপি সরকারও বেরিয়ে আসতে পারেনি। আওয়ামী লীগও সেই ধারা ছেড়ে দেয়নি। তাই যারা এ নিয়ে কথা বলছেন তাদের উচিত হবে নিজেদের পুরোনো ইতিহাসের দিকে তাকানো। আর ক্ষমতাসীনদের উচিত হবে-অতীতের নেতিবাচক বিষয়ে প্রভাবিত না হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যাতে পরে আপনাদের কর্মকাণ্ড অনুসরণে বাধ্য হয়।

সুতরাং আমি মনে করি, সংসদে আলোচনার উদ্দেশ্য যদি হয় বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের দায়ী করা, তাহলে এই আলোচনা সংসদের চার দেওয়ালের ভেতরেই থাকবে। আর মহান সংসদে এমন আলোচনা করা উচিত নয় যার সুফল সমাজে পড়বে না। বরং যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বিকভাবে যা হয় তার কারণ চিহ্নিত করার পাশাপাশি তা নির্মূলের ঘোষণা দিলে জাতি উপকৃত হতো।

অধ্যাপক ইসলাম বলেন, বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে চান না-এমন কথা যথাযথ নয়। কেননা যারা শিক্ষক হন তাদের এ ধরনের একটা প্রত্যাশাই থাকে, যেটা লোভ নয়, বরং দায়িত্ব ও জ্ঞানের বিষয়। কিন্তু উপাচার্য পদে যেতে যদি দলীয় রাজনীতিতে নাম লেখানোর বিষয় থাকে, তাহলে যাদের সামান্যতম আত্মসম্মান আছে, তাদের তো উপাচার্য হওয়ার জন্য পাওয়া যাবে না।

ড. ইসলাম বলেন, উপাচার্য হতে না চাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির প্রভাব। স্থানীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতিক আর ছাত্র-যুব ও শ্রমিক সংগঠন যদি উপাচার্যের কক্ষে প্রবেশ করে নিয়োগের জন্য চাপ দেন। সেখানে গুণী অধ্যাপকের উপাচার্য হতে না চাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।

তিনি বলেন, আশানুরূপ ফল পেতে হলে সবার আগে উপাচার্য নিয়োগের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া করতে হবে। আর এজন্য জাতীয় ঐকমত্য বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় আর উপাচার্য নিয়োগ রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে। দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়নের পরিবর্তে যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হবে, সেখানে ডিনদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। ওই কমিটিতে প্রয়োজনে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও থাকতে পারেন। তারা কমিটির বাইরে থেকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের তালিকা করে তার সঙ্গে কথা বলে তালিকা চূড়ান্ত করবেন। পরে সেখান থেকে আচার্য বা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন। আর উপাচার্যের ক্ষমতা বিশেষ করে নিয়োগে ক্ষমতা কমাতে হবে। তার কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন প্রতিবছর সিনেটে উপস্থাপন করতে হবে। এখানে সংসদীয় কমিটির কাজ আছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কার্যক্রম পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করবেন। আর শিক্ষার মান বাড়াতে অন্যান্য পদক্ষেপের পাশাপাশি শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষক মূল্যায়ন প্রথা প্রবর্তন করা খুবই জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া সহযোগী অধ্যাপক না করার নিয়ম ইতিহাস হয়ে থাকবে। এখন ‘রিস্ট্রাকচারিং’ পদ্ধতিতে পদোন্নতিও বন্ধ করা দরকার।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম