
প্রিন্ট: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০২ এএম
ভোজ্যতেলে কারসাজি: রিফাইনারি ও ঢাকার পাইকার জড়িত

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
রিফাইনারির গেটে গোপনে সয়াবিনের মূল্য বাড়ানো হয়। প্রচুর মজুত থাকার পরও দেশে তৈরি করা হয় কৃত্রিম সংকট। সরবরাহের ক্ষেত্রে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) এবং সাপ্লাই অর্ডারে (এসও) বাধার সৃষ্টি করা হয়। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই এসব করে আসছে রিফাইনারিগুলো। এর সঙ্গে পরে যুক্ত হয় পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের কিছু পাইকার। সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং ক্রেতার পকেট কেটে বেশি মুনাফার জন্য রিফাইনারি ও পাইকারদের চক্রটি পরিকল্পিতভাবে কাজটি করে। মূলত এদের কারণে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহে তারা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
ভোজ্যতেল নিয়ে কারসাজির প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেছেন, এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে। ভোজ্যতেল নিয়ে কারা কারসাজি করেছে, কোন সময় এবং কীভাবে করেছে সব আছে। এখন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে বলা হয়, রিফাইনারিগুলোয় ভোজ্যতেলের মজুত পর্যাপ্ত। দেশের মোট ৭টি মিলে পরিশোধিত ভোজ্যতেলের মজুত আছে ১৯ হাজার ৭৩৭ টন। আর অপরিশোধিত ১ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৯ টন। এ দুই পর্যায়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬০৬ টন ভোজ্যতেল মজুতের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এছাড়া সরবরাহ ব্যবস্থায় কমপক্ষে ১০ শতাংশ তেল এমনিতেই মজুত থাকে। এ হিসাবে প্রায় ৮০ হাজার টন তেল বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা দোকানে রয়েছে। সব মিলে সরবরাহ ও মজুতের পরিমাণ ২ লাখ ৭৬ হাজার টন। পাশাপাশি মিলগুলো তেলের এলসি খুলেছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৮০০ টন, যা দেশে আসার অপেক্ষায় পাইপলাইনে আছে। বিপরীতে এখন থেকে আসন্ন রমজানের পুরো সময়ে দেশে ২ লাখ ৬৭ হাজার টন তেলের দরকার হবে। এই চাহিদার চেয়ে এখনো ৯ হাজার টন বেশি আছে। পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়ায় আছে আরও ২ লাখ ৭২ হাজার টন। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে সেটি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, মিলগেট দিয়ে যে পণ্য পাইকারের হাতে যাবে, সেখানে এসও (সাপ্লাই অর্ডার) স্লিপ ব্যবহার হয়। নিয়ম অনুযায়ী এই এসওতে পণ্যের বিক্রীত মূল্য উল্লেখ থাকার কথা। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, মিলগেটে এসওতে কোনো মূল্য লেখা হতো না। এর মাধ্যমে রিফাইনারিগুলো মূল্য কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের ইচ্ছামতো অঘোষিত মূল্যে ভোজ্যতেল পাইকারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাইকাররা নিজেদের মতো মূল্য নির্ধারণ করে তুলে দেয় খুচরা বিক্রেতার হাতে। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে দেশে ভোজ্যতেল বিক্রি হয়। এরই মাঝে বাজার থেকে এক লিটার তেলের বোতল হাওয়া হয়ে যায়। পাশাপাশি সংকটে বেশি মুনাফার লোভে অনেক ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন স্থানে গোপন মজুত গড়ে তোলে। এভাবেই ভোক্তার পকেট কেটে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মিল মালিক ও মৌলভীবাজারের কতিপয় পাইকার।
সূত্র আরও জানায়, এসও এবং ডিওতে মূল্য ঘোষণা দিয়ে ভোজ্যতেল বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে পুরোনো তেল মিলগুলো ধরে রাখে। সম্প্রতি ভ্যাট ও ট্যাক্স কমানোর পর ভোজ্যতেলের মূল্য হিসাব অনুযায়ী কমে আসে। কিন্তু সেই মজুত করে রাখা পুরোনো ভোজ্যতেল এখন মূল্য ঘোষণা ছাড়া মিলগেটে বিক্রির জন্য চিঠি দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে। চিঠিতে ১৫ রমজান পর্যন্ত মিলগেটে ভোজ্যতেল বিক্রির অনুমোতি চেয়ে এ চিঠি দিয়েছে রিফাইনারিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানফ্যুাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
অধিদপ্তর মনে করছে, এটি বাজার অস্থির করার অন্যতম কৌশল। অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছ থেকে আবেদন এসেছে। কিন্তু এ ধরনের কোনো অনুমতি দেওয়া হবে না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিরতার সঙ্গে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের কয়েক পাইকার জড়িত। সরকার নির্ধারিত মূল্য বেঁধে দেওয়ার পরও তার চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করেছে। এ ধরনের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, মৌলভীবাজারে কয়েকজন পাইকারও রিফাইনারিগুলোর সঙ্গে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিরতার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। চলতি সপ্তাহে ওই দোকানির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। এছাড়া এসও নিয়ে পাইকারি বাজারেও সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
রিফাইনারিগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। কারণ প্রতিটি রিফাইনারির মালিক প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে আসতে হবে।