Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রুশ আক্রমণে বাংলাদেশের বাণিজ্যে বাধা

ইউক্রেনের সঙ্গে এলসি স্থগিত

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইউক্রেনের সঙ্গে এলসি স্থগিত

রুশ সামরিক বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এলসির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। আর রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে খোলা এলসির বিষয়ে ‘ধীরে চল নীতি’ অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে দুদেশের সঙ্গেই নতুন কোনো এলসি খোলা হচ্ছে না। যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে ব্যাংকগুলো। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হচ্ছে।

২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এখন পর্যন্ত যুদ্ধের প্রায় ১৭ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এর মধ্যেই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূলত ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা কর্তৃক রাশিয়ার ওপর আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে। এর মধ্যে ব্যাংক লেনদেনে ও রাশিয়ান পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞাই প্রধান। ইউক্রেনের সঙ্গে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রুশ বাহিনীর আক্রমণের কারণে ওই দেশের সার্বিক ব্যবস্থাপনা প্রায় ভেঙে পড়েছে। যে কারণে ব্যাংক, বন্দর কাজ করতে পারছে না। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ইউক্রেনের সঙ্গে এলসির কার্যক্রম স্থগিত করেছে। ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ গম, লৌহ, সিলভারসহ নানা খনিজ পদার্থ আমদানি করে। এগুলোর জন্য প্রায় সব এলসিই বেসরকারিভাবে করা হয়। এর মধ্যে সোনালী ও জনতা ব্যাংকের এলসিই বেশি। এছাড়া সরকারিভাবে কিছু গম আমদানি করা হয় ইউক্রেন থেকে। ২৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশি পণ্যবাহী কোনো জাহাজ ছেড়ে আসেনি। এদিকে বাংলাদেশ থেকেও ইউক্রেনগামী কোনো পণ্যবাহী জাহাজ ছেড়ে যায়নি। ইউক্রেনের সঙ্গে বাণিজ্য হয় মূলত সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে। দেশটির সঙ্গে সিঙ্গাপুরের জাহাজ চলাচলও বন্ধ রয়েছে। কেননা ইউক্রেনে রাশিয়ার অব্যাহত হামলার পর দেশটির প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। ফলে ব্যাংকিং কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বন্দরের কার্যক্রমও ঠিকমতো চলছে না। কাস্টমস বিভাগও কাজ করতে পারছে না। অনলাইন ব্যবস্থাপনাও অচল হয়ে পড়েছে। ফলে কনটেইনারের নাম্বার থেকে শনাক্ত করার কাজও বাধার মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেনে বাংলাদেশের জাহাজে রুশ বাহিনী কর্তৃক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এ জন্য আগে খোলা আমদানির এলসির মধ্যে যেসব পণ্য গত এক সপ্তাহ আগে জাহাজীকরণ করা সম্ভব হয়নি সেগুলো জাহাজীকরণ করতে নিষেধ করছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেও তারা এ ব্যাপারে যোগাযোগ করছেন। ইউক্রেনের ব্যাংকিং লেনদেনের ক্ষেত্রে বেলজিয়াম ভিত্তিক অনলাইনে আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থা সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশনের (সুইফট) কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও নিরাপত্তার কারণে এখন লেনদেনও বন্ধ রয়েছে। ফলে ইউক্রেনে আমদানির বিল পরিশোধ যেমন বন্ধ, তেমনি রপ্তানির বিল দেশে আনাও বন্ধ রয়েছে। রেমিট্যান্সের অর্থ আসাও প্রায় বন্ধ।

ইউক্রেন থেকে রেমিট্যান্সের অর্থ দেশে আনতে ফেব্রুয়ারিতে জনতা ব্যাংক ওই দেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী রেমিটেন্সের অর্থ ওই ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আসার কথা। কিন্তু সেটি কার্যকর হওয়ার আগেই যদ্ধের কারণে সব স্থগিত হয়ে গেল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানি-বাণিজ্য খুবই কম। এর মধ্যে ইউক্রেনে বাংলাদেশ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে রপ্তানি করেছিল ২০ কোটি টাকার পণ্য। গত অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছিল ৪০৬ কোটি টাকার পণ্য। গত অর্থবছরে আমদানি করেছে ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকার পণ্য। এর আগের অর্থবছরে তা ছিল সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার পণ্য। তবে ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ছিল। এদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বাড়ছিল ইউক্রেনে। যে কারণে ইউক্রেনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো ঘাটতি ছিল না। বরং উদ্বৃত্ত ছিল। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ইউক্রেনের বিনিয়োগ খুবই সামান্য অর্থাৎ ২ কোটি ৩১ লাখ ডলার বা ১৯৮ কোটি টাকা। ২০১০ সাল থেকে তারা বাংলাদেশে সীমিত বিনিয়োগ শুরু করে।

রাশিয়ার অর্থায়নে বাস্তবায়িত দেশের একমাত্র পারমাণবিক রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সাড়ে ৫ হাজার রুশকর্মীর পাশাপাশি দেড় হাজার ইউক্রেনের নাগরিক কর্মরত রয়েছে। এদের লেনদেন কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ লেনদেন হতো। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর মধ্যে সুইফটের মাধ্যমে কয়েকটি বড় ব্যাংকের লেনদেনও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ কারণে অর্থ আটকে যেতে পারে এ আশঙ্কায় সুইফটের মাধ্যমে কোনো লেনদেন হচ্ছে না। এমন কি যেসব ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়নি সেসব ব্যাংকের সঙ্গেও লেনদেন হচ্ছে না।

এদিকে রাশিয়া থেকে ঋণের অর্থ এখন জরুরি প্রয়োজনে না আসলে সরকারের অংশ থেকে প্রকল্পে অর্থের জোগান দেওয়া হচ্ছে। রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থ লেনদেনে বিকল্প পথ বের করলেও সেগুলো আপাতত ব্যবহার করা হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বিষয়গুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা ও ঝুঁকি না নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, ইউক্রেনের সঙ্গে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূলত যুদ্ধের কারণে তাদের দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। আর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সুইফটে ও জাহাজ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, আক্রমণ করছে রাশিয়া। রাশিয়াতে কোনো আক্রমণ নেই। আছে শুধু বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। এ কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলোকে বলা যায় অদৃশ্যমান বিধিনিষেধ। এই অদৃশ্য বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা আটকে গেছে।

সূত্র জানায়, যুদ্ধের আশঙ্কার পর থেকে ইউক্রেনের মুদ্রা হ্রিবনিয়ার দরপতন হতে থাকে। যুদ্ধ লেগে যাওয়ার পর তা আরও কমে যায়। তবে ১০ মার্চ থেকে মুদ্রার মান আবার বাড়তে থাকে। যুদ্ধের আগে ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রতি হ্রিবনিয়ার দাম ছিল ৩ টাকা ২ পয়সা। যুদ্ধ শুরু হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি তা কমে প্রতি হ্রিবনিয়ার দাম দাঁড়ায় ২ টাকা ৮৬ পয়সা। ১০ মার্চ দাম বেড়ে আবার ২ টাকা ৯৩ পয়সায় উঠে। ওই দরেই এখন মুদ্রাটির লেনদেন হচ্ছে। আলোচ্য সময়ে মুদ্রার দরপতন হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ বা ৯ পয়সা।

এদিকে ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডা কর্তৃক রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের। মূলত সুইফটের ওপর ও জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এ দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ গত অর্থবছরে রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ৪৮ কোটি ডলারের পণ্য। রাশিয়ায় রপ্তানি করেছে ৫৪ কোটি ৭১ লাখ ডলারের পণ্য। এদিকে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের আরও কিছুটা দরপতন হয়েছে। ডলারের বিপরীতে দরপতনের হার ৪৯ শতাংশে উঠেছে।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম