তৎপর ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর
ভোজ্যতেলের বড় দুই কারখানায় অভিযান
কৃত্রিম সংকটের জন্য দায়ী বড় ব্যবসায়ীরা-মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২২, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভোজ্যতেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে তদারকির অংশ হিসাবে রোববার দেশের দুটি বড় কারখানায় অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর। চট্টগ্রামের মইজ্যারটেক ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে পৃথক অভিযানের সময় বেশ কিছু অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার কথা স্বীকার করেছে সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সঙ্গে জড়িতরা কেউ ছাড় পাবে না। প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকান ও গুদামে অভিযান চালানো হয়েছে। এসময় গোডাউন সিলগালা ও জরিমানা করা হয়। খবর চট্টগ্রাম ব্যুরো, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ), ভোলা, রামগঞ্জ (লক্ষ্মীপুর) ও গলাচিপা প্রতিনিধিদের।
রূপগঞ্জে একটি বড় সয়াবিন তেলের কারখানায় অভিযানের পর জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকটের জন্য বড় ব্যবসায়ীরা দায়ী। আমাদের তদন্তে সেই রকমই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ভুল তথ্য প্রচার করে বাজারে দাম বাড়ানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে স্থানীয় বাজারে দাম বাড়তে পারে এমন ধারণা থেকে বড় ব্যবসায়ীরা তেল মজুত করেন। একইসঙ্গে দামও বাড়িয়ে দেন। ফলে খোলাবাজারেও এর দাম বেড়ে যায়। অনেকে তেল মজুত করায় কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রামে অভিযান : কর্ণফুলী থানাধীন মইজ্যারটেক এলাকায় অবস্থিত এস আলম ভেজিটেবল অয়েল কারখানায় অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সংস্থার চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে রোববার দুপুরে চালানো এ অভিযানে প্রতিষ্ঠানের তেল বোতলজাতকরণের সেকশন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তেলের কারখানা সংশ্লিষ্টরা অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তাদের কাছে দাবি করেছেন, মেরামতের জন্য তিনদিন ধরে এ সেকশনটি বন্ধ রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এ কারখানায় তেল বোতলজাতকরণ সেকশন বন্ধ থাকলেও চালু আছে ড্রামে করে তেল বিক্রির প্রক্রিয়া। অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনিছুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা কারখানা-সংশ্লিষ্টদের বলে এসেছি দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত শেষ করে তারা যেন বোতলজাত তেল উৎপাদন শুরু করেন। উৎপাদন শুরু করে তারা যাতে আমাদের অবহিত করেন, সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ। উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাসরিন আক্তার, আনিছুর রহমান ও চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক দিদার হোসেন।
অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, ওই দিন নগরীর বাকলিয়া এলাকায় বিসমিল্লাহ সুপার নামে একটি দোকানে অভিযান চালানো হয়। এতে ৫ লিটারের একটি পুষ্টি ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের গায়ে দাম ৭৯৫ টাকা লেখা থাকলেও ক্রেতার কাছ থেকে ৮০০ টাকা নিতে দেখা যায়। ৫ টাকা বেশি নেওয়ার কারণে এ প্রতিষ্ঠানকে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া একইদিন নগরীর পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে তেলের বিভিন্ন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্মকর্তারা। তারা জানার চেষ্টা করেছেন তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ।
রূপগঞ্জে তেলের মিলে মনিটরিং : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শবনম অয়েল মিলে অভিযানের সময় প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। উপজেলার তারাবো পৌরসভার তারাবো বাজার এলাকায় রোববার দুপুরে কারখানায় মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের নেতৃত্বে মনিটরিংয়ের সময় উপস্থিত ছিলেন সংস্থার উপ নির্দেশক বিকাশ চন্দ্র দাস, সফিউল আলম তাসলিমসহ আরও অনেকে। এ সময় মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বিভিন্ন কারখানায় মনিটরিং, তথ্য যাচাই-বাছাই ও তদারকি শুরু করেছি। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মূল্য বাড়িয়েছে কিনা সেটিও মনিটরিং করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে যে তথ্য ছড়ানো হয়েছে বাজারে সয়াবিন নেই সেটি কেবলই গুজব। প্রত্যেকটি মিলে সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। কিন্তু কিছু মিল মালিক ও এজেন্ট অধিক মুনাফার আশায় বাজারে তেলের সংকট দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, কিছু বড় ব্যবসায়ীর কারসাজিতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা সব মিলে গত তিন মাসের উৎপাদন ও সরবরাহের তালিকা তৈরি করেছি এবং এই প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেব।
এর আগে সয়াবিন তেলের অতিরিক্ত দাম রাখায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর আবুল খায়ের ট্রেডার্স নামের একটি ডিলারের দোকান সিলগালা করা হয়। এই ডিলারের কাছে থাকা ৬০ ব্যারেল ভোজ্যতেল জব্দ এবং দুই লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়। ৫ মার্চ দুপুরে অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এসব ব্যবস্থা নিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যৌথভাবে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত। ৬ মার্চ রাজধানীর কাওরান বাজারে অভিযান পরিচালনা করে বেশি দরে তেল বিক্রি ও তেল থাকলেও নাই বলার কারণে এক পাইকারি প্রতিষ্ঠান সাময়িক সময়ের জন্য সিলগালা করা হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশাসন তেলের কৃত্রিম সংকটের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
জানা গেছে, প্রশাসনের ব্যাপক তদারকির পর থেকে কিছু কিছু স্থানে তেলের মূল্য সামান্য কমেছে। তবে বেশির ভাগ এলাকায়ই আগের বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ভোলা : ভোলায় স্টেডিয়াম সড়কে ইউসুফ মহলের নিচতলার তিনটি কক্ষ থেকে রোববার সন্ধ্যায় ৬ হাজার ২০০ লিটার সায়াবিন তেল জব্দ করেছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আকিব ওসমান। এ সময় তিনটি কক্ষই সিলগালা করা হয়। কৃষি বিপণন ও ট্রেড লাইসেন্স না থাকায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় ইউনিকন ডিস্ট্রিবিউটর লিমিটেডের ম্যানেজার রাসেদুল আমনকে।
রামগঞ্জ (লক্ষ্মীপুর) : লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে রোববার দুপুরে মা ভিলা নামের পরিত্যক্ত একটি বাড়ি সিলগালা করে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তা মনিরা খাতুন। ইউনিকর্ন ডিস্ট্রিবিউশন লি. কোম্পানি পরিচয়ে রূপচাঁদা তেলের স্টিকার ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল সেখানে গুদামজাত করে রাখা হয়েছিল। মা ভিলার মালিক মৃত রাজ্জাক মিয়ার ভাগ্নে সায়মন হোসেন জানান, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীকে প্রতি মাসে ৭ হাজার ৫শ টাকা হারে আমি বাসা ভাড়া দিয়েছি। কিন্তু তেলের গুদামের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
গলাচিপা ও দক্ষিণ (পটুয়াখালী) : পটুয়াখালীর গলাচিপায় ৫ হাজার ৩শ লিটার সয়াবিন তেল মজুত করায় দোকানির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন জানায়, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেনের নির্দেশে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমখোলা বাজারে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম অভিযান চালিয়ে মেসার্স কামিয়াব এন্টারপ্রাইজ নামক রড ও টিনের দোকানে ৫ হাজার ৩শ লিটার সয়াবিন তেল মজুতের সত্যতা পাওয়া যায়। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।
সোনাগাজী (ফেনী) : ফেনীর সোনাগাজীতে সিমেন্টের গুদামে ৯১২ লিটার ভোজ্যতেল মজুত করার দায়ে মেসার্স আজিজ ট্রেডার্সের মালিক আজিজুল হককে দশ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সোনাগাজী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লিখন বণিক রোববার দুপুরে আমিরাবাদ ইউনিয়নের মানু মিয়ার বাজার এলাকায় এ অভিযান চালান। এ সময় ওই গোডাউনে ৫৭টি কার্টনে ৯১২ লিটার ফ্যামিলি ব্র্যান্ডের ভেজিটেবল ওয়েল ফর্টিপাইড পাম অলিন পাওয়া যায়। বাজারে কৃত্রিম তেলের সংকট তৈরি করে তেল মজুতের দায়ে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫৬ মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটির মালিক আজিজুল হককের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। একই সঙ্গে আগামী ৩ দিনের মাঝে মজুতকৃত সব তেল খুচরা বাজারে সরবরাহ করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুল হক হিরনকে তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।