হাদিসুরের মায়ের আহাজারি
সবাই এলো, আমার ছেলে কোথায়

যুগান্তর প্রতিবেদন ও বরগুনা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ছেলে হাদিসুরকে হারিয়েছেন বাবা-মা। তাই সন্তানের ছবি বুকে চেপে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
শেষবারের মতো সন্তানের মুখ দেখার আকুলতা ঘিরেছিল তাদের। সেদিনের ঘটনার তরতাজা স্মৃতি নিয়ে ফিরেছেন হাদিসুরের সহকর্মীরা। নিজেরা বেঁচে ফিরলেও রেখে আসতে হয়েছে হাদিসুরের লাশ। এজন্য তারাও শোকাচ্ছন্ন। হাদিসুরের মায়ের প্রশ্ন-‘সবাই ফিরে এলো, আমার সন্তান কোথায়।’
এদিকে যে ভাইয়ের দেখানো স্বপ্নে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া তার অকাল মৃত্যুতে যেন দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে অনার্স পড়ুয়া দুই ভাইয়ের জীবনে।
সব আশা হারিয়েও ফেরাতে চান ভাইয়ের লাশ। আর জমি বেঁচে ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো বাবার সংসারের হাল ধরেছিলেন হাদিসুর।
সুদিন ফিরলেও তা তছনছ করে দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এখন তারা তাকিয়ে আছেন সরকারের সহায়তার আশায়। হাদিসুরের মা বলেন, আমরা কিচ্ছু চাই না। শুধু লাশটা চাই। আমার আদরের ধনকে ফেরত চাই। আজ তো আমার ধন আসার কথা ছিল। কিন্তু সে কোথায় আছে তা এখনো জানি না।
নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলছেন না। লাশটি দেশে আনার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চাচ্ছি। বুধবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি গেটের সামনে ইউক্রেনে ‘এমভি বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে হামলায় নিহত হাদিসুর রহমানের মা রাশিদা আকতার এসব কথা বলেন।
এই সময় তার পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে পুরো শাহজালালের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। হাদিসুরের ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স ভাইয়ের জন্য ফ্লোরে গড়াগড়ি করে চিৎকার করে শুধু লাশ চাই শব্দটি বলছিলেন। তাকে কেউ সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না।
এমভি বাংলার সমৃদ্ধির ২৮ নাবিক দেশে ফেরার খবর পেয়ে বরগুনা থেকে ঢাকায় আসেন হাদিসুরের মা রাশিদা আকতার, বাবা আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার, ছোট দুই ভাই তারিকুল ইসলাম ও গোলাম মাওলা প্রিন্স। সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন স্বজন।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নেমে তারা সরাসরি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটের সামনে আসেন। দুুপুর পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ এদিক-ওদিক ছুটছিলেন গোলাম মাওলা প্রিন্স। তার চিৎকারে হঠাৎ কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারেননি। চিৎকার করে প্রিন্স বলতে থাকেন আমার ভাই ইউক্রেনে, আমার ভাই মারা গেছেন। তার লাশটি কি ভাই দেশে এসেছে? তখন উপস্থিত সবাই বুঝতে পারেন ফ্লোরে লুটিয়ে পড়া প্রিন্স হাদিসুরের ভাই। এ সময় সংবাদকর্মীরা তাকে ঘিরে ধরেন।
হাদিসুরের মা রাশিদা আকতার বলেন, আমার আদরের ধনকে ফেরত চাই। সুস্থ ও সবল একটি ছেলে জাহাজে উঠেছিল। আজ তার নিথর দেহ কোথায় আছে তা আমরা জানি না। আমার ছেলের লাশটি দেশে এনে দেন। তার চেহারাটা এক নজর দেখতে চাই।
আমার ছেলেকে শেষবারের মতো ছুঁয়ে দেখতে চাই। তিনি বলেন, হাদিসুর ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিল। প্রতিটি ক্লাসে সে প্রথম হতো। তাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। আগামী মাসে তার দেশে আসার কথা ছিল।
আগামী নভেম্বরে তাকে বিয়ে করানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের। দু-একটি মেয়েও দেখেছিলাম। এমনকি একটি মেয়েকে পাত্রী হিসাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। সে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করে। কিন্তু আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ কেন এতবড় শাস্তি দিল আমাকে? এই কথা বলেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
হাদিসুরের স্বজনেরা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁদে উঠছিলেন। ভাই হারানোর শোকে মাতম করছিলেন গোলাম মাওলা প্রিন্স। চিৎকার করে এক পর্যায়ে তিনি সড়কেই শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর পানি পান করতে চান।
গোলাম মাওলা প্রিন্স যুগান্তরকে বলেন, ‘আমারে নিয়া আমার ভাইয়ের কত স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেল। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জানাচ্ছে না আমার ভাইয়ের লাশ কোন দিন দেশে আসবে।’ হাদিসুরের বাবা আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার কান্নার কারণে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিলেন না। হাতে থাকা ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, এটা আমার ছেলে। আমার বাবা আইলো না।
হাদিসুরের ছোট ভাই তারিকুল ইসলাম বলেন, আমরা জানতাম ২৮ জন নাবিক আসবে। এর সঙ্গে ভাইয়ের লাশও আসবে, টিভিতে দেখেছি। আমরা ভাইয়ের লাশ দেখতে চাই। তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিনও ফোনে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল। ভাই বলতেন আন্তর্জাতিক শিপে আছি আমরা। কোনো সমস্যা হবে না। আমার ভাইয়ের জন্য বুকটা কেমন করে, কেমন খালি খালি লাগে। ভাই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র অবলম্বন।
হাদিসুরের চাচাতো ভাই সোহাগ হাওলাদার বলেন, আমার ভাই মারা যাওয়ার সঙ্গে পরিবারের উপার্জনক্ষম একমাত্র মানুষ আর থাকল না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে হাদিসুরের ছোট দুই ভাইয়ের জন্য যেন চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি যেন আমাদের পরিবারকে দেখেন। অবরসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক ও গৃহিণী রাশিদা আকতারের ৪ সন্তানের মধ্যে মেজো ছিলেন হাদিসুর রহমান আরিফ।
স্বপ্ন ছিল বাড়ি এসে তুলবেন নতুন ঘর। ছোট ভাইদের উচ্চ শিক্ষার দায়িত্বও ছিল হাদিসুরের কাঁধে। সব স্বপ্ন থমকে গেছে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে।
হাদিসুর ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি থেকে পাশ করে বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে যোগ দেন থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বরগুনার বেতাগীর কদমতলা এলাকায়ও।
এদিকে হাদিসুরের লাশ দ্রুত দেশে আনার জন্য কাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমানের লাশ ইউক্রেনের একটি বাংকারের ফ্রিজারে রাখা হয়েছে। সুবিধাজনক সময়ে লাশটি দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।
পোল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুলতানা লায়লা হোসেন বুধবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, হাদিসুরের লাশ সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। দুদিনের মধ্যেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ইউক্রেনে নিখোলাভ শহর থেকে অডিসা হয়ে মলদোভা দিয়ে রোমানিয়ায় পাঠানো হবে লাশ।
সেখান থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, যেভাবে নাবিকদের পাঠানো হয়েছে, সেই পথেই আমরা হাদিসুরের লাশ পাঠাতে চাচ্ছি। তিনি বলেন, ইউক্রেনের অডিসা শহরের পরিস্থিতি এখন একটু খারাপ। পরিস্থিতি একটু উন্নতি হলেই লাশ স্থানান্তরের কাজ করা হবে।
তিনি জানান, ইউক্রেন থেকে এ পর্যন্ত ৭শ’ বাংলাদেশি পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অনেকে পরে সেখান থেকে অন্যান্য দেশে চলে গেছেন।
কিছু শিক্ষার্থী আছেন, যারা পোল্যান্ডে পড়তে চাইছেন। তাদের আমরা সহযোগিতা করছি। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হলে ২৯ জন ক্রু নিয়ে অলভিয়া বন্দরে আটকা পড়ে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজটি। ২ মার্চ সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হন।