সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিশেষজ্ঞদের অভিমত
আর্থিক খাতে অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণ জরুরি

হামিদ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতীকী ছবি
আর্থিক খাতে যত অনিয়ম, দুর্নীতি, বিচারহীনতা এবং সুশাসনের অভাব-সবকিছুর পেছনে কলকাঠি নাড়ে একটি অদৃশ্য শক্তি। এ শক্তি অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার দৃশ্যমান কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু সবকিছু ধামাচাপা দেয় তারাই। অথচ কুচক্রী এই মহলটি সব সময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদৃশ্য শক্তির থাবা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আর্থিক খাত আরও ধসে পড়বে। এ থেকে পরিত্রাণে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়ার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের আরও যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। রোববার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ও জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সরকারের শীর্ষমহলের নির্দেশনা বা নিয়ন্ত্রণে চলে। সে কারণে আর্থিক খাতে নৈরাজ্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে এককভাবে দায়ী করা যায় না। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নামে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে তা ভোগ করতে পারছে না। সত্যিকারভাবে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে যে ব্যাংকিং বিভাগ চালু আছে, তা বিলুপ্ত করতে হবে। সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী থাকার সময় একবার বিভাগটি বিলুপ্ত করা হলেও পরে তা আবার চালু হয়েছে। এটা বন্ধ হলে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ আরও কার্যকর হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে কিছুটা দোষারোপ করার সুযোগ থাকে। তবে মনে রাখতে হবে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় অধিকাংশ ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হয়ে থাকেন। সুতরাং ব্যাংকের মালিকরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, এটা আশা করা বাতুলতা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আর্থিক খাতের আজকের করুণ অবস্থার জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। ঘরে-বাইরে একটি অদৃশ্য প্রভাবশালী গোষ্ঠী সব অপকর্মের পেছনে কলকাঠি নাড়ে। যাদেরকে কখনো প্রকাশ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে দেখা যায় না। এই গোষ্ঠীর প্রভাবের কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর থেকে উত্তরণে ওই অদৃশ্য প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ক্ষমতা কমাতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দুর্বৃত্তরা আর্থিক খাতে লুটপাট করে যাচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছে। এখানে কারও না কারও তো দায় ছিল। সে বিচার আজও হয়নি। লুটপাটের কারণে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বসে গেছে। সাধারণ মানুষের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। এর সঙ্গে জড়িত কাউকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। ব্যাংকিং কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের, সেটাও করা হয়নি। আগে লুটপাটকারীদের সামাজিক অবস্থান ছিল না। এখন উলটো তারাই সমাজপতি। সে কারণে তাদের সামাজিকভাবেও বর্জন করা যায় না। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ যা দেখানো হয়, বাস্তবে এর কয়েক গুণ বেশি হবে। এর গন্তব্য কোথায়, কেউ জানে না। এখন মানুষ হতাশ, হাল ছেড়ে দিচ্ছে; কোনো আশা নেই। তিনি আরও বলেন, নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা না হলে এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
প্রসঙ্গত, আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে উত্তরণে সম্প্রতি ১০ দফা সুপারিশ করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। সুপারিশগুলো হচ্ছে-অর্থ পাচার প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ সব দুর্নীতিবাজের তালিকা জাতীয় সংসদসহ গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে। ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচার রোধে সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
বড় ঋণখেলাপিরা যাতে কেউ বিদেশে যেতে না পারে, সেজন্য নৌবন্দর, স্থলবন্দর ও বিমানবন্দরগুলোয় তাদের তালিকা পাঠাতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। ব্যাংকিং সেক্টরে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন-এমন দক্ষ পেশাদার ব্যক্তিকে এসব পদে নিয়োগ দিতে হবে। নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা যাচাই করা উচিত। চরম লোকসানি ব্যাংকগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে। সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাচার করা অর্থের অঙ্ক ও পাচারকারীদের নাম সংগ্রহের জন্য সমঝোতা চুক্তি করতে হবে।