পাইলটের খামখেয়ালিপনার ১৩ সেকেন্ড
বিমানের ক্ষতি ৬০ কোটি টাকা
ফ্লাইট ডেটা মনিটর থেকে ফাঁস হয়েছে চাঞ্চল্যকর এই তথ্য, তদন্ত কমিটি গঠন * আকাশেই এয়ারক্রাফটির ইঞ্জিন জ্বলে যাওয়ার শঙ্কা ছিল * এত বড় ঘটনা লগ বইয়ে এন্ট্রি করেননি পাইলট, নিয়মিত ফ্লাইট করে যাচ্ছেন দুজন

মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাত্র ১৩ সেকেন্ডের অবহেলায় বিমানের একটি উড়োজাহাজের (S2-AKD) দুটি ইঞ্জিনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্টস জ্বলে গেছে। এমনকি দুটি ইঞ্জিনই জ্বলে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, এ ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি দাঁড়াতে পারে ৬০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে মেরামতের জন্য এক থেকে তিন মাস উড়োজাহাজটি দিয়ে ফ্লাইট করা যাবে না।
তাতে ক্ষতির অঙ্ক ১০০ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। ২ জানুয়ারি থেকে এয়ারক্রাফটি গ্রাউন্ডেড করে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করেছে বিমান।
জানা যায়, উড়োজাহাজটি আকাশে ওঠার পর পাইলট কোনো কারণ ছাড়া পাওয়ার লিভারটিতে ১০০ ভাগের বেশি ইমারজেন্সি পাওয়ার (ওয়াল টু ওয়াল) ব্যবহার করেছেন।
পরবর্তী সময়ে তড়িঘড়ি করে পাওয়ার লিভারটি আবার শতভাগের জায়গায় ডিটেন্টে নিয়ে এলেও দেখা গেছে ১৩ সেকেন্ড ব্যবহৃত হয়েছে।
বিমানের প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা যায়, এ ধরনের ঘটনায় সাধারণত বিমানের দুটি ইঞ্জিনই জ্বলে যাওয়া কিংবা ইঞ্জিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জ্বলে যাওয়ার কথা। যার কারণে শপে (ইঞ্জিন মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান) গেলে ৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ গুনতে হতে পারে বিমানকে।
ড্যাস-৮কিউ ৪০০ মডেলের এ উড়োজাহাজটি সম্পূর্ণ নতুন। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি এটি ঢাকায় আনা হয় কানাডার ডি হ্যাভিলেন্ড অ্যারোস্পেস থেকে। কানাডা ও বাংলাদেশ সরকারের জিটুজি চুক্তিতে উড়োজাহাজটি ক্রয় করা হয়। ৭৪ আসনবিশিষ্ট উড়োজাহাজটির নাম রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী বুধবার দুপুরে টেলিফোনে বিষয়টি শুনে অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, এতবড় ঘটনা তাকে জানানো হয়নি। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিমান এমডির সঙ্গে কথা বলবেন এবং তদন্তসাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ বিমানের বহরে নতুন আসা ড্যাস-৮কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ ‘আকাশতরী’তে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফ্লাইটটি (বিজি-৬০১) সেদিন সিলেট থেকে ঢাকা আসছিল।
ওই ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত। তিনি বিমানের পাইলটদের ট্রেনিং বিভাগের ডেপুটি প্রধান। জানা যায়, এ ঘটনার পর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এ পর্যন্ত আকাশতরী গ্রাউন্ডেড হয়ে বিমানের হ্যাঙ্গারে পড়ে আছে।
একই সঙ্গে বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশনকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু বিমানের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, উড়োজাহাজ গ্রাউন্ডেড করা হলেও এতবড় ঘটনার পরও দুই পাইলট বহাল তবিয়তে আছেন।
এখনো তাদের দিয়ে ফ্লাইট করানো হচ্ছে। অপরদিকে অভিযোগ উঠেছে-ফ্লাইট অপারেশন শাখার কোনো কর্মকর্তাকে দিয়ে এ ঘটনার তদন্ত করা হলে বাস্তবে কোনো ফল মিলবে না। কারণ, ইতোমধ্যে এ বিভাগ থেকে ক্যাপ্টেন রুবাইয়েতকে বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বিভাগেরই একটি সিন্ডিকেট।
এদিকে বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ডি হ্যাভিলেন্ড কানাডা (ডিএইচসি) ও ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি পেটেন্ট হুইটনিকে ইমেইলে জানানো হয়েছে।
ফিরতি মেইলে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে অবিলম্বে দুটি ইঞ্জিন তাদের নির্ধারিত শপে পাঠিয়ে চেক করার জন্য বলা হয়েছে। এর আগ পর্যন্ত উড়োজাহাজটি দিয়ে কোনো ধরনের ফ্লাইট না করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দুটি কোম্পানিই বিমানকে ইমেইলে জানিয়েছে, এ ধরনের দুর্ঘটনার পর এয়ারক্রাফটের দুটি ইঞ্জিনই জ্বলে যেতে পারে।
বিমানের একজন সিনিয়র পাইলট যুগান্তরকে বলেন, এতবড় ভয়াবহ ঘটনার পরও ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত বিষয়টি লগ বইয়ে এন্ট্রি করেননি। সাধারণত উড়োজাহাজ এবং ইঞ্জিনে ছোটখাটো কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলেই সেটি পাইলটদের লগ বইয়ে লিপিবদ্ধ করতে হয়।
যাতে পরের ফ্লাইটে যাওয়ার আগে প্রকৌশল শাখা সেটি অবহিত হতে পারে। প্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত লগ বইয়ে এন্ট্রি না করলেও এয়ারক্রাফটের ফ্লাইট ডেটা মনিটর (এফডিএম) থেকে তারা সবকিছু জেনে গেছেন।
এরপরই বিষয়টি প্রথমে বিমানের শীর্ষ পর্যায়ে জানানো হয়। তারপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ডিএইচসি এবং পিডব্লিউসিকে জানানো হয়।
পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন শাখার এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মূলত ওই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেনের অদক্ষতা, খামখেয়ালিপনা আর অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এ অবস্থায় পাওয়ার লিভারটি যদি আরও বেশি সময় সেখানে থাকত, তাহলে আকাশেই এয়ারক্রাফটির ইঞ্জিন জ্বলে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। তিনি বলেন, সাধারণ যে কোনো পাইলট এয়ারক্রাফট টেকআপের (উড্ডয়ন) সময় পাওয়ার লিভারটি একশ পারসেন্ট সামনে ‘ডিটেন্ট’ দাগ পর্যন্ত নিয়ে তারপর ব্রেক চেপে ফ্লাইট আকাশে উঠান।
এরপর সাধারণত আর পাওয়ার লিভার যায় না। এর বেশি নিতে হলে ধাক্কা দিয়ে (পুশ) নিতে হয়। সাধারণত ফ্লাইট আকাশে ওঠার পর আর পাওয়ার লিভার সামনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
যদি আকাশে কোনো ফ্লাইট জরুরি অবস্থায় পড়ে কিংবা যদি একটি ইঞ্জিন ফেল করে কিংবা যদি এয়ারক্রাফটের সামনে হঠাৎ পাহাড় চলে আসে, তখনই জরুরি ভিত্তিতে পাইলট লিভার পাওয়ার ডিটেন্ট দাগের পরে (ওয়াল টু ওয়াল) নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
কিন্তু ফ্লাইট ডেটা মনিটরের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, পাইলট কোনো কারণ ছাড়া সেদিন লিভার পাওয়ারটি একশ পারসেন্টের বেশি নিয়ে যান এবং ১৩ সেকেন্ড পর্যন্ত অবস্থান করেন।
কাতার এয়ারওয়েজের প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, লিভার পাওয়ারটি একশ পারসেন্টের বেশি অতিক্রম করলে ইঞ্জিনে হঠাৎ অতিরিক্ত ফুয়েল (তেল) চলে আসে। এতে ইঞ্জিন টারবাইনে অতিরিক্ত তাপমাত্রা তৈরি হয়।
যদি এ তাপমাত্রা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি অবস্থান করে, তাহলে কনভারশন চেম্বারে ঘুরতে থাকা কম্প্রেসার ব্লেডগুলো গলে যায়। সাধারণত উড়োজাহাজ জরুরি অবস্থায় পড়লে কম্প্রেসার ব্লেডগুলোকে বেশি ঘোরানোর দরকার হয়।
অর্থাৎ এয়ারক্রাফটের সামনে যদি হঠাৎ কোনো পাহাড় চোখে পড়ে, তখন পাইলট দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফ্লাইটটি উপরে তোলার জন্য এ কাজ করে থাকেন। কিংবা আকাশে একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে অন্য ইঞ্জিনের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য পাইলট এ কাজ করে থাকেন।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যদি বিমানের প্রকৌশল বিভাগ পরদিন ফ্লাইট ডেটা থেকে এ তথ্য বের করতে না পারতেন এবং যদি আরও ফ্লাইট পরিচালনা করা হতো, তাহলে যে কোনো সময় এয়ারক্রাফটি ক্র্যাশ করার আশঙ্কা ছিল।
তাতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতো। তিনি এ তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য বিমানের প্রকৌশল বিভাগের সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদও জানান। তাদের কারণে বিমান বড় দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছে।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, এতবড় ভয়াবহ ঘটনার পরও বিষয়টি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই বিমানে। উলটো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তবে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রুবাইয়েতকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান। উলটো ঘটনার পর থেকে সংশ্লিষ্ট পাইলট ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত ও কো-পাইলট ক্যাপ্টেন জামানকে দিয়ে ফ্লাইট ঝুঁকিপূর্ণভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে।
মঙ্গলবারও ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত ঢাকা-কলকাতা এবং ঢাকা যশোর ফ্লাইট করেছেন। সাধারণত এ ধরনের ঘটনার পর নিয়ম হলো সংশ্লিষ্ট পাইলটকে গ্রাউন্ডেড করে তদন্ত করা। কারণ ক্যাপ্টেন রুবাইয়েত বিমানের ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং হওয়ায় তিনি কর্মরত থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন রুবাইয়েতের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে ট্রেনিং বিভাগে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয় তিনি ফ্লাইট নিয়ে দেশের বাইরে আছেন।