যোগাযোগসহ নানা খাতে দুর্বলতা
ভালো নেই গ্রামের মানুষ
শহরের চেয়ে কেন বেশি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তা নিয়ে গবেষণা জরুরি-ড. আহসান এইচ মনসুর
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। নেই ভালো চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। অন্যান্য সেবার প্রসারও কম। ক্যানসারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার নজির গ্রামের মানুষেরই বেশি।
শহরের তুলনায় গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এমন কি খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও বেশি। গ্রাম থেকে টাকা এনে শহরের ঋণের জোগান বাড়ানো হচ্ছে। অথচ গ্রামে ঋণ প্রবাহ কম। কিন্তু আমানতের প্রবৃদ্ধির হার বেশি।
গ্রামে কর্মোপযোগী মানুষ বেশি থাকলেও স্থায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার কম। যোগাযোগ কাঠামোতেও রয়েছে দুর্বলতা। তাদের সুযোগগুলো কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমদামে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
অথচ নিরুপায় হয়ে তার প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বেশি দামে কিনছেন। এসব ক্ষেত্রে তারা অসহায়, তাদের কিছুই করার নেই। সব মিলে গ্রামের মানুষ ভালো নেই। যে কারণে উচ্চ শিক্ষা, ভালো চাকরি, ব্যবসা, চিকিৎসার সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসছেন একটু সামর্থ্যবান পরিবারের সদস্যরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের মোট আয়তন ১ লাখ ৪৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে গ্রাম বা পল্লি এলাকা ১ লাখ ৩৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং শহুরে এলাকা ১৪ হাজার ৭৫৭ বর্গ কিলোমিটার।
শহরের আয়তনের চেয়ে গ্রামের আয়তন ১ লাখ ১৪ হাজার ২৪৩ বর্গকিলোমিটার বেশি। অর্থাৎ ৮ গুণ বা ৮০০ শতাংশ বেশি। শহরের চেয়ে গ্রামে জনসংখ্যাও বেশি। এ হিসাবে গ্রামের উন্নয়নই দ্রুত ও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হচ্ছে না।
সেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশি হচ্ছে শহরকেন্দ্রিক। এর সুবিধাও পাচ্ছেন শহরের মানুষ। গ্রামকেন্দ্রিক যেসব উন্নয়ন হচ্ছে সেগুলোর অনেক সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন গ্রামের মানুষ।
২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ‘আমার গ্রাম আমার শহর’র আওতায় শহরের সব সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু শহরের সব সুবিধা গ্রামে পৌঁছেনি।
আর যেগুলো পৌঁছেছে তার সেবার মানও শহরের মতো ভালো নয়। যদিও পরিকল্পনা কমিশনের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার অনেকদূর এগিয়ে গেছে।
এর আওতায় উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ অবকাঠামো, সুপেয় পানির নিশ্চয়তা, প্রতিটি গ্রামে কমিউিনিটি স্পেস ও বিনোদনের ব্যবস্থা সমন্বিত কাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে নির্মাণ করা হয়েছে ডিজিটাল কেন্দ্র। যেখান থেকে গ্রামের মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির সেবা পাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হলেও শহরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চেয়ে বেশি সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঢাকার আশপাশের উপজেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ কঠিন। দীর্ঘ যানজট ও ট্রেন সার্ভিসের অপ্রতুলতাই এর কারণ।
শহরের মানুষের খাদ্যের জোগান আসে গ্রাম থেকে। অর্থাৎ গ্রামের মানুষ খাদ্য উৎপাদনের পর শহরে সরবরাহ করেন। খাদ্যের জোগানদাতা হিসাবে গ্রামের মানুষেরই বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হচ্ছে না।
তারা বরং অবহেলিত ও বঞ্চিত। ফলে কোনো পরিবার একটু সক্ষমতা অর্জন করলেই শিক্ষার জন্য সন্তানদের শহরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এমনকি সপরিবারে শহরে চলে আসার নজিরও আছে ভূরিভূরি। ভালো চিকিৎসার জন্য শহরের কোনো বিকল্পই নেই।
গ্রামে চাল, ডাল, শাকসবজি, মাস-মাংস উৎপাদন হচ্ছে। অর্থনীতির নিয়মে পণ্য যেখানে উৎপাদন হয় সেখানে সরবরাহ বেশি থাকে। যে কারণে দামও কম থাকে। এ কারণে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার কম থাকার কথা। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার আরও কম থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উলটাটা। শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি।
বিবিএসের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে । গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ, শহরে এ হার ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার গ্রামে ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ। শহরে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ১ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের আয় কম। আবার মূল্যস্ফীতিজনিত টাকা ক্ষয়ের দিক থেকে গ্রামই এগিয়ে।
এ অবস্থাকে এক ধরনের বঞ্চনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, গ্রামে খাদ্যের উৎপাদন হলেও সরবরাহ সংকট রয়েছে।
উৎপাদিত খাদ্য উপকরণ কৃষক বিক্রি করে দিলে একটি গ্রুপের হাতে চলে যাচ্ছে। তারা তখন বেশি দামে বিক্রি করছে। এছাড়া শহরে নায্যমূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হলেও গ্রামে এমনটি হয় না। যে কারণে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। আর খাদ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণেই গ্রামে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার বেশি হচ্ছে।
এর সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রামে সব ধরনের খাদ্য উপকরণের সরবরাহ বাড়াতে হবে। ছোট ছোট শিল্প স্থাপনে উৎসাহিত করে টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষার মানও বাড়াতে হবে। তাহলে মানুষ শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা কমবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে খাদ্যসহ অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের ক্ষেত্রে খরচ বেশি হচ্ছে। এ কারণে শহরের চেয়ে গ্রামে কিছু পণ্যের দাম বেশি। এতে মূল্যস্ফীতির হারে চাপ পড়ছে।
কৃষি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান। তার এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পণ্য উৎপাদন করেও কৃষক ধরে রাখতে পারেন না।
সঙ্গে সঙ্গে তা বিক্রি করে আগের ধারদেনা শোধ করেন। ফলে উৎপাদিত পণ্য ধান-চাল চলে যাচ্ছে একটি গ্রুপের হাতে। এ ধান বা চাল যখন কৃষক তার নিজের প্রয়োজনে কেনেন তখন বেশি দামে কিনতে হয়।
শাকসবজি যেগুলো উৎপাদন হয়, তার বেশিরভাগই চলে আসে শহরে। ফলে গ্রামের হাটবাজারে এসব পণ্যের দাম একেবারে উৎপাদনস্থলে কম হলেও একটু দূরে গেলেই দাম বেড়ে যায়। শহরতলি বিশেষ করে উপজেলাগুলোতে শহর থেকে শাকসবজি জোগান দেওয়া হয়। যে কারণে গ্রামে এসব পণ্যের দাম বেশি।
এতে আরও বলা হয়, পাইকারি পর্যায়ে দাম অনেক কম থাকে। কেননা উৎপাদনের সব গ্রামের মানুষ ভোগ করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে শহরে পাঠাতে হয়। শহরে পাঠানোর জন্য পাইকাররা সিন্ডিকেট করে দাম কমাতে ভূমিকা রাখে।
ফলে কৃষক উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছে না। উৎপাদিত পণ্য কৃষকের হাতের বাইরে এলেই দাম কয়েক দফা বেড়ে যায়। অথচ কৃষক উৎপাদিত পণ্যের নায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনায় খামারিরা দুধের দাম না পেয়ে রাস্তায় ফেলে প্রতিবাদ করার নজিরও রয়েছে। বিক্রি করতে না পেরে গ্রামের পাইকারি বাজারে সবজি ফেলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
নরসিংদীর বৃহত্তর পাইকারি সবজির বাজার বারুইচ্যায় গ্রাম থেকে সবজি নিয়ে এসে অনেকে বিক্রি করতে পারেন না পাইকারের অভাবে। সেগুলো ফেলে যাচ্ছেন। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সমন্বয় না থাকায় এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেনা শোধ করতে ফসল ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কৃষককে তা বিক্রি করতে হয়। যে কারণে কৃষক যখন আবার চাহিদা অনুযায়ী তারই উৎপাদিত পণ্য কিনতে যান তখন বাড়তি দাম দিতে হয়।
এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। ফসল উৎপাদন করে পণ্যের বিপণন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে গ্রামের মানুষ কম দামে পণ্য পান না। একই কারণে শহরে প্রতি লিটার ডিজেল সরকারি নির্ধারিত মূল্য ৮০ টাকা করে বিক্রি হলেও গ্রামে বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা বেশি দামে ১০০ টাকা লিটার। এভাবে অনেক পণ্য গ্রামে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
এছাড়া শহর থেকেও গ্রামে অনেক পণ্যের জোগান বেশি। সেগুলো শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানী থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলা সদর। এখানে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, সবজি, মাছ এগুলোর বড় চালান যাচ্ছে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে। পণ্যের পরিবহণ ও অন্যান্য খরচ বাবদ এর দাম বেড়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামের মানুষ সব সময়ই একটু পিছিয়ে থাকেন।
বিশ্বব্যাপীই এ চিত্র। এজন্য শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে শহরে আসেন মানুষ। যে কারণে শহরের পরিধি বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, কৃষকের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে। সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে খানার আয়-ব্যয়ের জরিপের ভিত্তিতে দারিদ্র্যের একটি নতুন মানচিত্র করা হয়। ২০২০ সালের নভেম্বরে এর কাজ শেষ হয়েছে। সে অনুযায়ী উন্নয়ন কম হয়েছে এমন বিভাগগুলোতে দারিদ্র্যের হার বেশি।
এর মধ্যে মোট দারিদ্র্যের সবচেয়ে বেশি রংপুর বিভাগে। এ বিভাগে দারিদ্র্যের হার ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। অর্থাৎ মোট দারিদ্র্যের প্রায় অর্ধেক। ময়মনসিংহে ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৮ দশমিক ৯৩, খুলনায় ২৭ দশমিক ৪৮ এবং বরিশালে ২৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা এ তিন বিভাগের প্রতিটিতে এ হার গড়ে ২০ শতাংশের নিচে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্যের হার বেশি। অতি দারিদ্র্যের হার গ্রামে আরও বেশি।
দেশের মোট দারিদ্র্যের ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ শহরে এবং গ্রামে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশের বাস। তবে আশার কথা হচ্ছে, শহরের চেয়ে গ্রামে দারিদ্র্য বেশি হারে কমছে। গ্রামে কমছে ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং শহরে কমছে ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, গ্রামে দারিদ্র্য কমাতে হলে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে।
এজন্য কৃষিভিত্তিক শিল্পে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। যেখানে যে শিল্পের কাঁচামাল পাওয়া সে শিল্প স্থাপনে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। গত বছরের আগস্টের জরিপ (বিবিএসর) অনুযায়ী শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের নানা ধরনের জটিল রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
এর মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন গ্রামের ৯ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ, শহরে এ হার ৮ শতাংশ। উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন গ্রামের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ, শহরে এ হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ক্যানসারের মতো মরণব্যাধিগুলোও গ্রামে হচ্ছে বেশি।
এর মধ্যে লিভার ক্যানসার ও ব্লাড ক্যানসার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। গ্রামের ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহরে এ হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্লাড ক্যানসারে ভোগেন গ্রামের ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ। শহরে এ হার ২ দশমিক ১ শতাংশ। প্যারালাইসিস ও সাধারণ জ্বরও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটি নতুন তথ্য। এ বিষয়ে গবেষণা দরকার। এটি হতে পারে গ্রামে আর্সেনিকের প্রভাব বেশি। এছাড়া রান্নার ধোঁয়া, ধানের নাড়ার আগুন এগুলো ক্যানসার ও শ্বাসযন্ত্রের রোগ বাড়াতে পারে। তবে এই তথ্যের আলোকে জরুরিভিত্তিতে গবেষণা দরকার। কারণ গ্রামের মানুষ এসব রোগে বেশি আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
বিবিএসের গত বছরের আগস্টে প্রকাশিত জরিপ অনুযায়ী গ্রামে পাকা ও আধা পাকা ঘর ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ, অন্যান্য ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বিদ্যুৎ ব্যবহারেও শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ পিছিয়ে।
২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী গ্রামের ৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। শহরের বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
২০১৬ সালে গ্রামের ৬৫ দশমিক ৯ শতাংশ বাড়িতে স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহৃত হতো। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে শহরে ৮৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯১ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট আমানতের ৭৮ শতাংশ শহরের, ২২ শতাংশ গ্রামের। এর বিপরীতে মোট ঋণের ৯০ শতাংশ দেওয়া হয় শহরে, গ্রামে ১০ শতাংশ।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে শহরে আমানত বেড়েছে ১ দশমিক ৮৬ শতাংশ, একই সময়ে গ্রামে বেড়েছে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। শহরের চেয়ে গ্রামে আমনতের জোগান বাড়ছে। অথচ ঋণের জোগান কম।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য কম বলে ঋণের চাহিদাও কম। হাটবাজার, শিল্প এলাকাগুলোকে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউজ হিসাবে গড়ে তুললে ছোট ছোট ঋণের চাহিদা বাড়বে।
এতে গ্রামের উন্নয়ন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়-ব্যাংকের শাখার ৫১ শতাংশ শহরে, গ্রামে ৪৯ শতাংশ। সরকারি ব্যাংকের ১৬ শতাংশ শহরে, গ্রামে ১৯ শতাংশ শাখা। সেরকারি ব্যাংকের ৩১ শতাংশ শহরে, গ্রামে ১৮ শতাংশ।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিকাশ হচ্ছে গ্রামে। মোট এজেন্টের মধ্যে ১৪ শতাংশ শহরে, ৮৬ শতাংশ গ্রামে। হিসাবধারীদের মধ্যে ১৪ শতাংশ শহরে ও গ্রামে ৮৬ শতাংশ। ফলে গ্রামে ব্যাংকিং সেবার প্রসার ঘটছে।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট শ্রম শক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশই কৃষিতে জড়িত। কৃষির প্রায় পুরোটাই গ্রামে। সেবা ও শিল্প খাতের একটি অংশও গ্রামে রয়েছে। ফলে শ্রমশক্তির বড় অংশই গ্রামে।
শহরের মানুষের মাসিক গড় আয় ২২ হাজার ৬০০ টাকা, গ্রামের মানুষের ১৩ হাজার ৩৯৮ টাকা। শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ কম। মাসিক গড় ব্যয় গ্রামের মানুষের ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা এবং শহরের মানুষের ১৯ হাজার ৬৯৭ টাকা।
এ হিসাবে গ্রামের মানুষের ব্যয় কম ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রামের মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। ফলে তারা ঋণগ্রস্ত থাকেন। শহরের মানুষের যেমন আয়ও বেশি, তেমনি ব্যয়ও বেশি। কিন্তু শহরের মানুষের গড়ে আয়ের তুলনায় ব্যয় কম। ফলে তারা সঞ্চয়ী হন।