ইসির নির্লিপ্ততায় ভোটে নৈরাজ্য
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হতাহতের ঘটনায় নীরব নির্বাচন কমিশন।
কোনো দায় নিচ্ছে না তারা। কমিশনের নির্লিপ্ততা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতায় সহিংসতা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, ক্ষমতার জন্যই সমাজে এই নৈরাজ্য। এভাবে চলতে থাকলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, যা সুখকর হবে না-
ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতেই সামাজিক নৈরাজ্য: ড. তোফায়েল আহমেদ
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, সমাজ একটা দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু ইউনিয়ন পরিষদ নয়, ওয়ার্ডের নির্বাচনেও মারপিট হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, বড় নির্বাচন দূরের কথা- সামনে মসজিদ কমিটি ও স্কুল কমিটির মতো নির্বাচনেও মারামারি হবে। বৈধ-অবৈধ উপায়ে অনেকের টাকা হয়ে গেছে। এখন তাদের ক্ষমতা চাই। ক্ষমতার জন্য তারাই সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, সমাজটা দিন দিন একতরফা আধিপত্যের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যারা ইতোমধ্যে ক্ষমতাবান হয়ে গেছেন, তারা চান না নতুন করে কেউ আর গজিয়ে উঠুক। তাই যে এগিয়ে আসছে তাকেই মারধর করা হচ্ছে। আর মারধরের শিকার ব্যক্তি যদি প্রতিরোধ করে, তখনই তা মারামারি ও কাটাকাটিতে পরিণত হচ্ছে।
তিনি বলেন, যে কোনো মূল্যে আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে চায়। নতুন করে অনেকের পয়সা হয়েছে। এখন তারা ক্ষমতা চায়। কেননা ক্ষমতাও টাকা উপার্জনের একটা পথ। ক্ষমতা হস্তগত করতে পারলে টাকা আরও আসবে। তাই এখন মারামারি করে হলেও ক্ষমতাটা দখল করতে হবে। এই মানসিকতা থেকেই সহিংসতা হচ্ছে। দেশের এই সিনিয়র নাগরিক বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সবকটি ধাপ মিলে প্রায় ১শ লোক মারা গেছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, এর দায় তাদের নয়; যারা মারামারি করেছে তাদের। কিন্তু এর দায় তো অবশ্যই কাউকে না কাউকে নিতে হবে। নইলে দেশে সরকার আছে কেন? যারা মারা গেছে তারা তো দলীয় লোক। দলীয় লোকদের প্রতিও যদি কোনো দায় না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে!
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। বিষয়টা গোটা সমাজের উপলব্ধিতে আসতে হবে। পাশাপাশি দেশ-সমাজ যেখানেই যাক আমার ক্ষমতা থাকতে হবে-এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। আর একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। দেশে আইন ও প্রশাসন আছে। সরকার আছে। কাউকে না কাউকে এই প্রাণহানির দায় নিতে হবে। দায় নিলে এবং আইন বাস্তবায়ন আর সরকার আন্তরিক হলে অবশ্যই মারামারি-কাটাকাটি বন্ধ করা সম্ভব।
নির্বাচন নয় ভোট ছিনতাই হচ্ছে: ড. এম সাখাওয়াত হোসেন
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রথম থেকেই সহিংসতা সামাল দিতে কমিশন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে দিনদিন এটি আরও বাড়ছে। এ পর্যন্ত সহিংসতায় জড়িত কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়নি। কারও বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি দৃশ্যমান কোনো আইনি ব্যবস্থা। বিচারহীনতার কারণে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, জোর যার মুল্লুক তার। এখন ইলেকশন হচ্ছে না, ভোট ছিনতাই হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এ ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। নির্বাচনব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাহীনতা স্থায়ী হলে জাতীয় নির্বাচনে এর চেয়েও খারাপ অবস্থা হতে পারে। বৃহস্পতিবার যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, সহিংসতার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততা। নির্বাচন কমিশনের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে। জনগণের টাকায় কমিশনাররা নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুধু সুষ্ঠুভাবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচনটা করতে পারছেন না। তারা সহিংসতার দায় অন্যের ঘারে চাপিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রকাশ্যে সরকারি দলের নেতারা যে ধরনের কথাবার্তা বলছেন, হুমকি দিচ্ছেন, তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বর্তমান নির্বাচনব্যবস্থায় এই সহিংস পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ খুব কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা দরকার। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আরও দৃঢ়তা দেখাতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হবে।
সংসদ নির্বাচনে অবস্থা হবে আরও ভয়ংকর: বদিউল আলম মজুমদার
স্বার্থপরতার রাজনীতির কারণেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে সহিংস ঘটনা ঘটছে। যতদিন রাজনীতির এই ধারা অব্যাহত থাকবে, ততদিন সবাই মরিয়া আচরণ করবে-এমন মন্তব্য করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যতদিন পার পাওয়া যাবে, ততদিন এই অবস্থা চলতেই থাকবে। এ ঘটনা সামাল দেওয়া সম্ভব না হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ সংসদ-সদস্যের পদবি এখন সোনার হরিণ। সংসদ-সদস্য হওয়া মানে জমিদার হওয়া, যা রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বানিয়ে দেয়।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও এখন এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা বাড়ছে। দলভিত্তিক মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের আরও বেপরোয়া করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে সহিংসতা সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কেউ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
একদিকে সহিংসতায় একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনার বলছেন এসবের দায় তাদের না। কমিশনের এসব বক্তব্য হাস্যকর। তাহলে কমিশনের কাজ কি শুধু বসে বসে বেতন নেওয়া। লোভনীয় সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা।
তিনি আরও বলেন, কমিশন যদি কঠোর হস্তে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন, নির্বাচন বাতিল করতেন, তাহলে এই সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এত প্রাণহানির পরও কোথাও নির্বাচন বাতিল করা হচ্ছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নির্বাচন কমিশনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে ধারাবাহিকভাবে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা বাড়লেও কমিশন নির্বিকার। এতে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা আশকারা পাচ্ছে। যার ভবিষ্যৎ পরিণতি সুখকর হবে না।