Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

৩৩২ নম্বর পিলারে ‘ভয়াবহ ত্রুটি’

বড় কিছু নয়, হানিকমের সৃষ্টি হয়েছিল বলে পিলারটি ভাঙা হচ্ছে-প্রকল্প পরিচালক

Icon

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

৩৩২ নম্বর পিলারে ‘ভয়াবহ ত্রুটি’

নির্মাণে ত্রুটি পাওয়ায় ভেঙে ফেলা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৩৩২ নম্বর পিলার। রোববারের ছবি -যুগান্তর

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ৩৩২ নম্বর পিলারে ভয়াবহ নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়েছে। নির্মাণ কাজ মানসম্মত না হওয়ায় পিলারটি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। নাখালপাড়া এলাকায় দায়সারাভাবে পিলারটির নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করে এনেছিল ঠিকাদার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজটি যথাযথভাবে তদারকি করেনি বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো তদারক কর্মকর্তার চোখে পিলারের এই ত্রুটি ধরা পড়েনি। একজন নির্মাণ শ্রমিক বিষয়টি টের পেলে টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ হয় নির্মাণ কাজ মানসম্মত হয়নি। এ অবস্থায় পিলারটি রাখা যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত হয় ভেঙে ফেলার। এরপরই গত বৃহস্পতিবার থেকে ভাঙার কাজ শুরু হয়। ড্রিল মেশিন দিয়ে উপরের দিক থেকে এটি ভাঙা হচ্ছে। রোববার দুপুরে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে স্থানীয় লোকজন ও নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘পিলারটি ঢালাইয়ের সময় হানিকমের (ছোট ছোট ছিদ্র থেকে তৈরি শূন্যতা) সৃষ্টি হয়েছিল। ঢালাই করতে গেলে অনেক সময় এরকম হয়ে থাকে। এটা বড় কোনো ত্রুটি নয়।’ বড় কোনো ত্রুটি না হলে পুরো পিলার ভাঙতে হচ্ছে কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা ওদের নতুন করে কাস্টিং করে দিতে বলেছি। সেটা করার জন্যই ওরা পিলারটি ভেঙে ফেলছে। এখানে দায়সারাভাবে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম ধাপে ইটালিয়ান থাই কোম্পানি কাজ করেছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে চায়না কোম্পানি সিএসআই ও সিনোহাইড্রো কাজ করছে। পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনার শিপ) প্রজেক্টে ঠিকাদার নিয়োগ নিয়ে আামাদের কিছু বলার নেই।’

রোববার বেলা একটা। নাখালপাড়া হোসেন আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে দাঁড়াতেই চোখ আটকে যায় ৩৩২ নম্বর পিলারে। নেট দিয়ে ঘেরা পিলারটির নিচের একাংশ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। উপরের দিক থেকে বিকট শব্দ আসছে। উড়ছে ধুলা। কাছে যেতেই দেখা গেল দুজন শ্রমিকের হাতে দুটি ড্রিল মেশিন। কিছুক্ষণের বিরতিতে তারা একসঙ্গে মেশিন দুটি নিচের দিকে চেপে ধরছেন। তাতেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে পিলারের অংশ। কেন ভাঙা হচ্ছে পিলারটি-এমন প্রশ্নের জাবাবে এক শ্রমিক বললেন, ‘শুনছি নিচের দিকে ফেল করেছে। মানে ফাইসা গ্যাছে। আমগো ভাঙতে কইছে তাই ভাঙছি। আর কিছু কইতে পারমু না।’

তবে প্রকল্পে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহ আগে পিলারটির নিচের দিকে ফুটো দেখতে পায় একজন শ্রমিক। ফুটোতে রড ঢুকিয়ে চাপ দিতেই কিছু অংশ ভেঙে পড়ে। বিষয়টি জানাজানি হলে হৈচৈ শুরু হয় উচ্চ পর্যায়ে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাতে দেখা যায় পিলারের ভেতরে কিছু অংশ ফাপা (ভয়েড)। এরপরই পিলারটি ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয় ভাঙ্গার কাজ।

শ্রমিকদের কাজ তদারককারী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই উন্নয়ন প্রকল্প আমাদের জাতীয় সম্পদ। তদারকির জন্য নিয়োজিত প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতার কারণে এই ভয়ানক ত্রুটি একটু হলেই চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল। এই ত্রুটি কেউ ধরতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপদের শঙ্কা ছিল। এখন শুধু চোখে দেখা অংশ ভাঙলে চলবে না। পাইলিং কী অবস্থায় আছে সেটি পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পাইলিংয়ের উপরে পাইল ক্যাপ ঠিক আছে কিনা-সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। যদি মাটির উপরে দৃশ্যমান অংশ ভেঙে আবার পিলারটি নির্মাণ করা না হয় তাহলে ঝুঁকির শঙ্কা থেকেই যাবে।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব যুগান্তরকে বলেন, পিলার নির্মাণ কাজে হানিকম ও ভয়েড দুটোই ক্ষতিকর। পিলারে হানিকম থাকলে সেখান দিয়ে পানি ঢুকে, শ্যাওলা জমবে। সেখান দিয়ে গাছ গজাবে। এক পর্যায়ে ড্যাম ধরে পিলারটি দুর্বল হয়ে যাবে। আর ভয়েড তৈরি হলে বেশি চাপ পড়লে পিলার ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পুরো পিলারটি যেহেতু ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সব ধরনের পরীক্ষায় এটি অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। এটা সতর্ক বার্তা হিসাবে নেওয়া উচিত। আর সতর্ক না হলে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির আশঙ্কা থেকে যাবেই। এক্ষেত্রে এখন দরকার বিশাল বিনিয়োগে এই জাতীয় সম্পদের মানসম্মত নির্মাণ নিশ্চিতে একটি পরিবীক্ষণ দল গঠন করা। রাজউকের অধীনে সব ধরনের সরঞ্জাম রয়েছে। শুধু পরিবীক্ষণ দল গঠন করলেই সব পিলার স্ক্যানিং করে মান নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় এটাই প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প। এতে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ৮শ’ ৬৯ কোটি ৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, মগবাজার, কমলাপুর সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালি এলাকায় গিয়ে শেষ হবে। এর দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের কাজ পায় ইটালিয়ান থাই কোম্পানি। প্রথম ধাপে কোম্পানিটি বিমানবন্দর থেকে কাকলী পর্যন্ত কাজ তুলতেই অর্থ সংকটে পড়ে। এরপর ইটালিয়ান থাই কোম্পানি চায়না আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে সাব ঠিকাদার হিসাবে নিয়োগ দেয়। এরাই দ্বিতীয় ধাপে কাকলী থেকে মগবাজার পর্যন্ত নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পালন করছে। শ্রমিকের চোখে একটি পিলালে ত্রুটি ধরা পড়ার পর পুরো কাজের তদারকি নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, এই কাজের সুপারভিশন কর্মকর্তাদের একেক জনের মাসিক বেতন ৫-৬ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিচালকের অধীনে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, অন্তত ৩ জন সহকারী প্রকৌশলী ও ৫ জন উপসহকারী প্রকৌশলী রয়েছেন। মোটা বেতনে আছেন একাধিক পরামর্শক। এদের চোখ এড়িয়ে নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে কীভাবে একটি পিলার উপরের দিকে উঠে গেল সেই প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে।

সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, তদারক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি ‘রিসেটেলমেন্ট প্রজেক্ট’-এর দিকে। ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্টের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৮০০ কোটি ব্যয়ে উত্তরায় রাজউক অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে এই রিসেটেলমেন্ট প্রজেক্ট। বেসরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পে নির্মাণ কাজ করছে। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তারা ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজের চেয়ে এই কাজ দেখভাল করতেই তারা বেশি আগ্রহী। অভিযোগ আছে, এই প্রকল্পে ইচ্ছামতো পরিবর্তন এনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা পাইয়ে দিয়ে নিজেরাও লাভবান হচ্ছে। এসব কাজে ব্যস্ত থাকায় এলিভেটেড প্রকল্পে চীনা কোম্পানির কাজ তদারকিতে পড়েছে ভাটা।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘পিপিপি প্রজেক্টে যতখানি নজরদারির কথা তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। আর রিসেটেলমেন্ট প্রজেক্টে মাত্র একজন প্রকৌশলী কাজ করছেন। বাকি সবাই এলিভেটেডের কাজ তদারকিতে নিয়োজিত। এই প্রজেক্টের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়।’

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম