রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ
সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় * ৭ দফা আদায়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম

যুগান্তর প্রতিবেদন ও ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। বসতবাড়ি, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের প্রতিবাদে নানা জায়গায় আয়োজিত বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে এ ডাক দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মুসলমানরাও যোগ দেন। তারা বলেন, ধর্মীয় পরিচয় নয়, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখতে হবে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যারা এই সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করতে চায়, তাদের শনাক্ত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অপচেষ্টা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। ধর্ম, মত ও পথ ভুলে এক্ষেত্রে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম পালনের অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাব, শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন সর্বস্তরের মানুষ। কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী ও রংপুরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়িতে আক্রমণের প্রতিবাদে এসব কর্মসূচি পালিত হয়। বিভিন্ন মন্দির ও আশ্রমের ধর্মগুরু, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন। প্রতিবাদ শুরু হয় জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে। সোমবার সকালে প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষুব্ধরা মানববন্ধন করেন। এ সময় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। তা উপেক্ষা করেই তারা শাহবাগে যান। এখানে সড়ক অবরোধ করে চলে বিক্ষোভ। তাদের অভিযোগ, উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে হামলা চালানো হয়েছে। এ সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তারও অভিযোগ করেন তারা।
এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে শাহবাগে কয়েক ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ চলতে থাকে। কর্মসূচি থেকে স্বাধীন কমিশন গঠন করে জড়িতদের শাস্তি ও বিচারের দাবি জানানো হয়। সাত দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে শেষ হয় শাহবাগের কর্মসূচি। অবরোধ ছেড়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রমনা কালীমন্দিরে যান বিক্ষোভকারীরা। সেখানে সমাপ্তি টানা হয় প্রতিবাদ কর্মসূচির। দুপুর ২টার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
সোমবার সকালে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সমবেত হন জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে তারা মিছিল নিয়ে শাহবাগ মোড়ে আসেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তার ওপর বসে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তাদের অবরোধের কারণে শাহবাগ থেকে পল্টন, সায়েন্স ল্যাব, বাংলামোটর ও টিএসসি অভিমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তারা নানা ধরনের স্লোগান দেন। অবরোধের একপর্যায়ে রমনা কালীমন্দির, বাংলাদেশ ইসকন, ঢাবির সনাতনী বিদ্যার্থী সংসদসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সঙ্গে সংহতি জানান।
আন্দোলনকারীদের সাত দফা দাবির মধ্যে রয়েছে-হামলার শিকার মন্দিরগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ক্ষতিপূরণ; ধর্ষণ ও হত্যার শিকার পরিবারগুলোকে স্থায়ী ক্ষতিপূরণ; দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা; জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মন্দির ও সংখ্যালঘুদের বসতবাড়িতে সাম্প্রদায়িক হামলার দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। এর বাইরে তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে-সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের আধুনিকায়ন করে ফাউন্ডেশনে উন্নীত করা এবং জাতীয় বাজেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য জিডিপির ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা।
শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রমনা কালীমন্দিরের সভাপতি ও ঢাবির সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান লতিতা মন্ডল বলেন, বাংলাদেশে যখন কোনো পূজাপার্বণ হয়, তখন হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্যও প্রার্থনা করে। যাতে তিনি সুস্থ থাকেন, সুষ্ঠুভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারেন। অনেকে শেখ হাসিনাকে মাতৃসম শ্রদ্ধাও করেন। তাই আজকে এখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি, যখন হেফাজত শাপলা চত্বর অবরোধ করে, তখন তিনি পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে তাদের সেখান থেকে তুলে দেন। ঠিক একইভাবে আমরা চাই যারা মন্দিরে হামলা করেছে, তাদের গ্রেফতার করা হোক।
অবরোধে যোগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। সবার শরীরে একই রক্ত প্রবাহিত। তাহলে এ ধর্মীয় উন্মাদনা কেন? আমরা রোহিঙ্গা নই, আমরা বাংলাদেশি। আমরা আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রাখি। আমাদের এই অধিকারে যারা হাত দিয়েছে, তাদের হাত আমরা ভেঙে দেব। আমরা এভাবে রাস্তা অবরোধ করতে চাইনি। কিন্তু আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। যারা আমাদের কারণে যানজটে পড়ে আছে, তাদের কাছে আমরা ক্ষমা চাই। বাংলাদেশ ইসকনের প্রচার সম্পাদক অমানী কৃষ্ণ বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি। যতক্ষণ তাদের দাবি মেনে না নেওয়া হবে, ততক্ষণ আমরা তাদের সঙ্গে থাকব।
এরপর বেলা ২টার দিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আলটিমেটাম দিয়ে অবরোধ তুলে নেন আন্দলরত শিক্ষার্থীরা। অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে আন্দোলনের মুখপাত্র ঢাবি শিক্ষার্থী জয়জিৎ দত্ত বলেন, আমরা আমাদের কর্মসূচিতে কিছু দাবি জানিয়েছি। কিন্ত সেগুলো সম্পর্কে আমরা এখনো কোনো আশ্বাস পাইনি। তবে ইসকন প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। আমি সাংবাদিকদের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের যে দাবিগুলো আছে তা পূরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। এর মধ্যে যদি আমাদের দাবি মেনে নেওয়া না হয় কিংবা সারা দেশে আবারও হামলা সহিংসতা হয়, তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। জনদুর্ভোগ কমানোর কথা চিন্তা করে আমরা আজকের অবরোধ তুলে নিচ্ছি।
সম্প্রীতি বাংলাদেশের উদ্বেগ : বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। এক বিবৃতিতে সংগঠনের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল এ উদ্বেগ জানান। তারা বলেন, কুমিল্লায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা ও উৎসবের সময় এবং এর জের ধরে পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যা ঘটছে, তা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত।