বিআইএফসিতে লুটপাটের তদারকি
কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ৩ সংস্থা চুপ
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদন: শিগগিরই আদালতে উপস্থাপন * প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তাব আটকে রেখেছিলেন

দেলোয়ার হুসেন
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানিতে (বিআইএফসি) লুটপাটের ঘটনার সময় ‘নীরব দর্শকের ভূমিকা’য় ছিলেন তদারকির তিন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংস্থাগুলো হচ্ছে-বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং কোম্পানিগুলোর নিবন্ধক পরিদপ্তর যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিয়ন্ত্রক (আরজেএসসি)।
অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান অনিয়ম প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে লুটপাটের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। অথচ প্রতিটি সংস্থারই নিজস্ব আইনে অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার যথেষ্ট আইনি ভিত্তি ছিল।
আর্থিক খাতে জাল-জালিয়াতির বিষয়ে আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ বা ‘কারণ অনুসন্ধান’ কমিটির প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ১ অক্টোবর বিআইএফসির আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ওই কমিটি। প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে। আদালত তিনটি প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের বিষয়ে কারা কিভাবে জড়িত সে বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে বিআইএফসির তদন্ত প্রতিবেদন গভর্নরের কাছে জমা দেওয়া হলো। এখন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও পিপলস লিজিংয়ের ওপর তদন্ত হবে।
প্রতিবেদনে বিএফএফইসর অনিয়ম-দুর্নীতির প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব বিভাগের কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট ফাইলে স্বাক্ষর করেছেন তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধন নিয়ে বিআইএফসি আর্থিক কার্যক্রম শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লাইসেন্স দেখে আমানতকারীরা অর্থ জমা রাখেন। এখন আমানত ফেরত দিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতার দায় নিয়ন্ত্রক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংককেও নিতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির তাদকির দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, পরিদর্শনের দায়িত্ব পালন করত ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ ২ এর আর্থিক প্রতিষ্ঠান উপবিভাগ এবং পরে গঠিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ। এর মধ্যে নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালক মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ৬৭টি হিসাবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। বর্তমানে সুদসহ এটি বেড়ে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তিনি ১০৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকা পরিশোধ করেননি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় বদল হয়।
পরপর তিন দফা মালিকানা বদল হয়ে সেটি পিকে হালদার গ্রুপের কাছে যায়। আদালতের হস্তক্ষেপের আগে পিকে হালদারের ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার এর পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর পরিচালক ছিলেন পিকে হালদারের নিকটাত্মীয়রা। তারা এখন পলাতক। কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তরের সময় যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। যদিও মেজর (অব.) আবদুল মান্নান একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো টাকা আত্মসাৎ করেননি। তার কাছ থেকে মালিকানা বদল হওয়ার পরই টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিআইএফসির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে এতে প্রশাসক নিয়োগের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নিচের স্তর থেকে সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশ তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলম তার কাছে আটকে রেখেছিলেন। তিনি তা উপরের দিকে উপস্থাপন করেননি। ফলে এতে প্রশাসক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। এতে প্রশাসক নিয়োগ করলে পরে জালিয়াতির ঘটনাগুলো ঠেকানো যেত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের ২ এর আওতায় একটি উপবিভাগ ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিদর্শন করার জন্য। এ বিভাগ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ওপর যথাযথ পরিদর্শন হয়নি। পরে পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বিভাগ হলে সেখান থেকেও তদারকির অভাব ছিল। ওই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর একে সুর চৌধুরী। তদারকির ক্ষেত্রে তার গাফিলতি রয়েছে। যে কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের অনেক নেতিবাচক তথ্যই উপরের দিকে যেত না এবং প্রতিকারমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুর চৌধুরীর পর ডেপুটি গভর্নর হিসাবে এ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন এসএম মনিরুজ্জামন। কমিটি ওই দুই ডেপুটি গভর্নরসহ, নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তদারকি সংস্থা হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিচের স্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপরের স্তরের কর্মকর্তা যারা বিআইএফসির অবৈধ সুবিধা দেওয়ার তালিকার ফাইলে স্বাক্ষর করেছেন তাদের একটি তালিকা প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী এ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তাকেও তালিকায় আনা হয়েছে। তিনি অবসরে যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান এ বিভাগের দায়িত্বে আসেন। তিনিও ওই তালিকায় রয়েছেন।
২০১৫ সালের পর তিন দফা এর মালিকানা বদল হয়েছে। প্রতি দফায় মালিকানা বদল হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি নমনীয় ভূমিকা রেখেছে। তারা শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম পরিপালন করে অনুমোদন দেননি। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা বদলের ক্ষেত্রে শেয়ার হস্তান্তর করা হয়েছে বেনামি কোম্পানির নামে। এসব কোম্পানির নামে কিভাবে নিবন্ধন দেওয়া হলো সে প্রশ্ন তুলেছে কমিটি। কমিটির পক্ষ থেকে একটি পরিদর্শক দল কোম্পানিগুলোর ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শক দল ওই ঠিকানায় কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি।
এসব কোম্পানির নামে শেয়ার হস্তান্তরের আগে যেমন কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয়নি, তেমনি কোম্পানির পর্ষদ গঠনের ক্ষেত্রে অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিএসইসির সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা ছিল নীরব। কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে আরজেএসসি যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি। নিবন্ধন দেওয়ার পরও তারা এসব কোম্পানির কোনো তদারকি করেনি। তাদের কাছে কোম্পানিকে যেসব জবাবহিদিতা করতে হয় সেগুলো তারা করেনি। এ ব্যাপারে আরজেএসসি নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
তিন দফা মালিকানা বদলের ক্ষেত্রে প্রথম দফায় খ্যাতিমান লোকদের পরিচালক পদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। পরে বেনামে নেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ওই সময়ে ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিএসইসি শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি।
একই সঙ্গে আরজেএসসি নিবন্ধন দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন নিয়ম-কানুন মানেনি। তেমনি নিবন্ধন দেওয়ার পর তারা কোম্পানির কার্যক্রমে কোনো তদারকি করেনি। অথচ প্রতিটি পর্যায়ে সব সংস্থার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। তারা যে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি বলে এর সম্পদ লুটপাটের সুযোগ হয়েছে।
সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে কোম্পানিটি নিবন্ধিত হয়। ১৯৯৮ সালের মার্চে ব্যবসা শুরু করে। কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ৪০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ার ৪১ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বিআইএফসির মোট আমানতের পরিমাণ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮০৮ কোটি টাকা। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটি আর কোনো আমানত সংগ্রহ করতে পারেনি। মুনাফাসহ আমানতের পরিমাণ বেড়ে এখন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পিকে হালদার গ্রুপ প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে বেনামে কোম্পানি খুলে সেগুলোর নামে শেয়ার কিনে বিআইএফসির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
এসব কোম্পানির বেশিরভাগের ঠিকানা পুরানা পল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারে ও কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারে। বিআইএফসির মালিকানা যেসব কোম্পানির নামে ছিল সেগুলোর মধ্যে দুটি কোম্পানি ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের একই দিনে নিবন্ধিত হয়েছে।
বিআইএফসির অংশীদার ‘টিজ মার্ট ইনকরপোরেটেড’ নামে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এর পরিচালনা পর্ষদ অপসারণ চেয়ে আদালতে আবেদন করলে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ওই কমিটি গঠনের আদেশ দেন। আদালত বলেছেন, ২০০২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির প্রধান করা হয় ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খানকে। পরে আদালত আরও দুজনকে কমিটিতে যুক্ত করেন।