Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

তিনটি ই-কমার্সের প্রতারণা

আত্মসাৎ কয়েক কোটি টাকা

Icon

হক ফারুক আহমেদ

প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০২:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আত্মসাৎ কয়েক কোটি টাকা

প্রতারণার নতুন মাত্রা যোগ করেছে ই-কমার্সের তিন প্রতিষ্ঠান-সহজ লাইফ, লাইভলী লাইফ ও বিডি লাইক। এরা গাজীপুর ও লালমনিরহাটে থাবা বিস্তার করেছে।
 

সবার টার্গেট মধ্যবিত্ত পরিবারের সহজ সরল মানুষ। ঘরে বসেই লাভের প্রলোভনে তেমন কিছু না জেনেই বিনিয়োগ করেছেন হাজার হাজার টাকা। সুযোগ বুঝে বিনিয়োগের টাকা পকেটে ভরে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রতারকরা।

এরপরও ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই মামলা দায়েরে আগ্রহী নন। সহজ লাইফের নামে দু-একজন গ্রাহক মামলা করেছেন। তারা এফআইআরে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সিআইডি মামলাটি নিয়ে কাজ করেছে। পালিয়ে থাকায় তিন প্রতিষ্ঠানের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ই-কমার্সের তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহজ লাইফ অন্যতম। ১১শ টাকা বিনিয়োগ করে এই সহজলাইফের ওয়েবসাইটে খুলতে হবে একটি আইডি। প্রতিটি আইডির থাকে একটি পাসওয়ার্ড ও বিকাশ নম্বরও। আইডি খুললে প্রথমেই গ্রাহককে দেওয়া হয় ৮৫০ টাকার পণ্য। এরপর সহজ লাইফের সাইটে গিয়ে প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখতে হবে। প্রতিদিন বিজ্ঞাপন দেখার জন্য প্রতিটি আইডিতে যুক্ত হবে ২০ টাকা। সেই হিসাবে কেউ চাইলে একটি আইডিতে ঘরে বসে ৩০ দিনে আয় করতে পারবেন ৬০০ টাকা। কেউ যদি এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতি মাসে পাবে ৬০ হাজার টাকা। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সহজ লাইফের এমন সরল পথে আয়ের খবরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কাশিমপুর থানাধীন পূর্ব এনায়েতপুর এলাকার মানুষ। প্রথমে দু-তিন মাস গ্রাহকের অর্থ পরিশোধও করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকেই নানা অজুহাতে টাকা দিতে শুরু হয় গড়িমসি। এভাবেই কয়েক মাসে ওই ভুয়া প্রতিষ্ঠানটি ২৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী জাহিদুল ইসলাম গাজীপুরের কাশিমপুর থানায় মামলা করেছেন। তিনি প্রতারণামূলকভাবে অর্থ আত্মসাতের মামলা করেন। আসামি করেন সহজ লাইফের সিইও মো. তাহাজ্জুদ হোসেন, মার্কেটিং ডিরেক্টর মো. জামাল হোসেন ও মো. দেলোয়ার হোসেনসহ অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনকে। এজাহারে বলা হয়, বিবাদীরা ০১/০১/২০২১ থেকে কাশিমপুরের পূর্ব এনায়েতপুরে সাইফুল ইসলাম শেখের বাড়ি ভাড়া নিয়ে অফিস খোলেন। ই-কমার্স ব্যবসার নামে ‘সহজ লাইফ’ ‘লাইভলী লাইফ’ নামে দুটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান খুলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে।

কৌশলে বিভিন্ন পণ্যের প্রলোভন দেখিয়ে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করতে থাকে। প্রত্যেক আইডির বিপরীতে তারা ১১শ টাকা করে নেওয়া শুরু করে। ডিবিবিএল এজেন্ট ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট, নগদ, বিকাশ, রকেটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। প্রথমদিকে টাকার বিপরীতে গ্রাহকদের কিছু পণ্য সরবরাহ করে। এতে তাদের প্রতি মানুষের এক ধরনের আস্থা তৈরি হয়। এরপর ধীরে ধীরে তাদের চেহারা প্রকাশ হতে থাকে। টাকা নিলেও পণ্য সরবরাহে গড়িমসি করে। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর বিকালের দিকে কথিত অফিসে কাজকর্ম শেষে কেউ কিছু না বলে আসামিরা আত্মগোপনে চলে যান।

মামলার বাদী জাহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, থানায় যখন আমরা মামলা করতে যাই তখন সেখানে আরও ৫-৬ জন ছিলেন। আমার নিজের করা ১১শ আইডি ও বাকিদের আইডিগুলো মিলিয়ে বিশাল সংখ্যা দাঁড়িয়েছে। এখন পুলিশি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে প্রায় কেউই এ বিষয়ে কথা বলছেন না।

জাহিদুল বলেন, গত তিন মাসে সহজ লাইফ তার নাম পরিবর্তন করে লাইভলী লাইফ দেয়। বাসার মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে নিচতলায় বিভিন্ন মালামালের শোরুম চালু করে। বিজ্ঞাপন দেখার পাশাপাশি এই শোরুমের মালামাল বিক্রির মাধ্যমেও তাদের আয় হবে বলে জানায়। তারা ইনসেনটিভ ঘোষণা করে। কেউ যদি ১২১টি আইডি খোলে তাহলে তাকে ল্যাপটপ দেওয়া হবে। আর শুধু ২১টি আইডি খুললে নগদ পাঁচ হাজার টাকা অথবা মোবাইল দেবে। এমন ঘোষণার পর অনেক মানুষ একাই ১৩০-১৫০টি করে আইডি খুলেছে। এভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছে।

এদিকে মামলাটি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করেছে সিআইডি। সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম যুগান্তরকে বলেন, মামলাটি আমরা ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করেছি। আমরা তদন্তও শুরু করেছি। সেখান থেকে হয়তো আরও অনেক গ্রাহকের প্রতারণার তথ্য বেরিয়ে আসবে।

এদিকে কাশিমপুর প্রতিনিধি জানান, বুধবার সহজ লাইফের অফিসের ভাড়া বাড়িটি তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে। পরে আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময় প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী রাশেদুল হাসান, জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমানসহ আরও অনেকেই অভিযোগ করেন। তারা এমডি তাহাজ্জুদ হোসেন, তার সহযোগী জামাল হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন বিচারের দাবি জানান।

এনায়েতপুরের এক স্কুলশিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, কারখানার শ্রমিক, স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ তাদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আমি নিজে একদিনে তাহাজ্জুদ হোসেনের অ্যাকাউন্টে ৬ লাখ টাকা দিয়েছি। এছাড়া নগদ ৫০ হাজার টাকা ও বিকাশ রকেটের মাধ্যমে টাকা দিয়েছি। ওদের সফটওয়্যার চেক করলে টাকার সঠিক পরিমাণ জানা যাবে।

একই এলাকার অপর এক স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রাশেদুল ইসলাম রাশেদ বলেন, সুকৌশলে তাহাজ্জুদ হোসেন, জামাল হোসেন ও দেলোয়ার হোসেন আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। কত টাকা নিয়ে গেছে বলা যাচ্ছে না। কারণ তারা শুধু আমাদের এলাকার নয়, অন্য জেলার লোকজনও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেকে এখানে চাকরির সুবাদে বসবাস করেন।

তিনি নিজে আইডি খুলেছেন আবার নিজের গ্রামের অনেক লোককে দিয়ে আইডি খুলিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন সবাইকে একত্র করতে পারলে কত কোটি টাকা নিয়ে গেছে জানা যাবে।

কোনাবাড়ী এলাকার ফার্মেসির মালিক আবুল কাশেম বলেন, প্রথম প্রথম তারা মালামাল সাপ্লাই দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেয়। আর ২০ টাকা করে প্রতিদিন দেওয়ার কথা সেটা কখনো করেনি। মালামালের কথা বললে কয়েকবার সময় নিয়ে পরে সার্ভার বন্ধ করে পালিয়ে যায়।

এদিকে অনলাইনের মাধ্যমে পাঠানো লিংকে লাইক দিলে মিলবে টাকা। এছাড়া ৬০ সেকেন্ডের একটা বিজ্ঞাপন দেখলেও টাকা পাওয়া যাবে, এমন প্রলোভনে গা ভাসিয়ে প্রতারিত হয়েছেন লালমনিরহাট জেলার অনেকেই। প্রতারকরা জেলা সদরে বিডি লাইক নামের অনলাইন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

লালমনিরহাট প্রতিনিধি জানান, প্রতারণার শিকার হয়েছেন অনেকেই। এখন প্রায় কেউ কথা বলতে চাচ্ছে না। তবে ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, ওই ওয়েবসাইট থেকে পাঠানো লিংকে লাইক দিলে ৬ টাকা করে পাওয়া যাবে। সেই ৬ টাকার হিসাব ঠিক রাখতে আবার লাইক দেওয়ার স্ক্রিন শর্ট নিয়ে ওয়েবসাইটে পাঠানো হয়। এজন্য অনেকেই ২ হাজার টাকা দিয়ে একটি করে আইডিও খোলেন। শর্ত ছিল ১০৫২ টাকা হলেই ওই টাকা তোলা যাবে। এভাবে ১০ থেকে ১৫ দিন লাইক দিয়ে প্রায় ৮-৯শ টাকা জমা হয় একজনের আইডির বিপরীতে। কিন্তু গত ২০ দিন ধরে ওই ওয়েবসাইটে ঢোকা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। এছাড়া আরও নানাভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার যুগান্তরকে বলেন, বিজ্ঞাপন দেখার নামে অ্যাকাউন্ট খুলে টাকা আয়ের বিষয়ে প্রতারণা সংক্রান্ত বেশকিছু তথ্য আমরাও জেনেছি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হয়েছে। আমরা বারবার সচেতন হওয়ার কথা বলছি। কিন্তু সহজ সরল সাধারণ মানুষ অনেকটা গণহারে এ ধরনের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম