Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ লোপাট

আমানত সংগ্রহে ঘুস ৬৪ কোটি টাকা

৩৩০০ কোটি টাকার ঋণ আদায় অনিশ্চিত * ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে বন্ধকী সম্পদ ৭শ কোটি টাকা

Icon

মাহবুব আলম লাবলু

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমানত সংগ্রহে ঘুস ৬৪ কোটি টাকা

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) নজিরবিহীন সব দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসছে। অভিনব কায়দায় অর্থ আত্মসাতের পর এবার আমানত সংগ্রহ করতে ঘুস দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বিভিন্ন ধরনের এক হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করার জন্য এজেন্ট কমিশন হিসাবে ৬৪ কোটি টাকা ঘুস দেওয়া হয়েছে তিন ব্যক্তিকে। চেকের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহের এজেন্ট বলে খ্যাত নূর মোহাম্মদ, রাসেল ও রাজ্জাক এসব চেক গ্রহণ করে টাকা নগদায়ন করে নেন।

আর্থিক লেনদেনে স্তরে স্তরে ভয়ংকর এমন দুর্নীতির কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবেদ হাসান ও সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী। মার্চে ওই দুই কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশন গ্রেফতার করেছে।

তারা আরও বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটির থেকে দেওয়ার মোট ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে বন্ধকী সম্পদ রয়েছে মাত্র ৭০০ কোটি টাকার। ফলে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ আদায় একেবারেই অনিশ্চিত।

এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আমানত সংগ্রহ করার জন্য কমিশন বা এজেন্ট নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রতিষ্ঠানের শাখার মাধ্যমে কর্মকর্তারা আমানত সংগ্রহ করবেন। এর বিপরীতে কোনো এজেন্ট কমিশন বা ঘুস দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে সুদ বা মুনাফার হারে কম-বেশি হতে পারে। এটি প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে গ্রাহককে সন্তুষ্ট করার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আমানত সংগ্রহের নামে যে কমিশন দিয়েছে এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। পিকে হালদারের সংশ্লিষ্ট লোকেরাই এজেন্ট কমিশনের অর্থ আত্মসাৎ করে থাকতে পারে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার বলে তারা মনে করেন।

আদালতে ওই দুই কর্মকর্তা বলেছেন, আইএলএফএসএল বেনামে মূলত পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠান ছিল। ৫-৭ কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রতিষ্ঠানটিতে সব ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন করিয়ে সেই টাকা পিকে হালদারের নির্দেশে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তার কথার বাইরে কোনো কাজ করার সাধ্য কর্মকর্তাদের ছিল না।

আইএলএফএসএলের প্রধান হিসাব কর্মকর্তা (সিএফও) হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন সৈয়দ আবেদ হাসান। পরে তিনি ভারপ্রাপ্ত এমডি হন। আদালতে দোষ স্বীকার করে তিনি বলেন, ২০১৬ সালের অক্টোবরে আমি নিয়োগপত্র পাই। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন এমডি রাশেদুল হক আমাকে নিয়োগপত্র দেন। প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের সব সদস্যই ছিল মূলত পিকে হালদারের লোক।

প্রতিটি পর্ষদ সভায় পিকে হালদার নিজে উপস্থিত থেকে ঋণ অনুমোদনে ভূমিকা পালন করতেন। তার নির্দেশেই বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়া, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ কোনো জামানত না নিয়েই ব্যাংকিং রীতিনীতির বাইরে ঋণ প্রস্তাব তৈরির পর অভ্যন্তরীণ অফিস নথিতে সই করা হতো।

এ কাজে এমডি রাশেদুল হক, অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (এভিপি) আল মামুন সোহাগ, সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, কোম্পানি সেক্রেটারি রফিকুল ইসলাম খান জড়িত। পর্ষদে ঋণ অনুমোদন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ওই অর্থ না পাঠিয়ে পিকে হালদারের মৌখিক নির্দেশে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হিসাবে পাঠাতেন।

এ প্রক্রিয়ায় আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ প্রদানের নথিতে আমি, রাশেদুল হক, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরী ও রফিকুল ইসলাম খান সই করি। পরে পিকে হালদারের নির্দেশে ঋণের ওই টাকা তার (পিকে হালদার) বিভিন্ন কোম্পানি ও পছন্দের ব্যক্তিদের হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

জবানবন্দিতে তিনি জানান, পিকে হালদারের নির্দেশে এবং রাশেদুল ইসলাম, নাহিদা রুনাই ও অভিক সিনহাসের যোগসাজশে তিনি লিপরো ইন্টারন্যাশনাল নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ১৬টি চেকের মাধ্যমে ১১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৪১ হাজার ৮৯৭ টাকা প্রদান করেন, যা বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির হিসাবে প্রেরণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে বিভিন্ন ধরনের আমানত সংগ্রহ করার কমিশন হিসাবে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। নূর মোহাম্মদ, রাসেল ও রাজ্জাক কমিশন এজেন্ট হিসাবে এসব কমিশনের চেক নেন।
আইএলএফএসএলের সাবেক সিনিয়র ম্যানেজার রাফসান রিয়াদ চৌধুরী আদালতে দোষ স্বীকার করে বলেন, করপোরেট ফাইন্যান্স বিভাগে চাকরির সুবাদে আমি গ্রাহকদের সিআইবি থেকে শুরু করে ঋণ প্রস্তাব তৈরি ও অনুমোদনের জন্য ক্রেডিট কমিটিতে প্রস্তাব পাঠানোর কাজ করতাম। ঋণ প্রস্তাবে আমি ছাড়াও ৩ থেকে ৫ জনের সই থাকত। এর ওপর ভিত্তি করেই ক্রেডিট কমিটির সুপারিশের আলোকে পর্ষদের জন্য মেমো তৈরি হতো। যেখানে শুধু ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সই থাকত, যা পর্ষদ সভায় উপস্থাপনের পর অনুমোদনসাপেক্ষে ঋণ বিতরণ করা হতো।

তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে পিকে হালদার বিভিন্ন অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিকদের এনআইডি, ট্রেড লাইসেন্স, ঋণ প্রস্তাব, টিন সার্টিফিকেট এবং সিআইবি রিপোর্ট ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হকের কাছে পাঠাতেন।

রাশেদ তা নাহিদা রুনাই বা আল মামুন সোহাগের হাতে দিয়ে ঋণ প্রস্তাব তৈরি করতে বলতেন। নাহিদা রুনাই কিংবা আল মামুন সোহাগ সেই কাগজগুলো আমার হাতে দিয়ে কোনোরকম যাচাই-বাছাই, পরিদর্শন প্রতিবেদন ও জামানত ছাড়াই ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে দিতে বলতেন। তাদের নির্দেশ মতো পুরো ফাইল তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের সই নিয়ে তা পর্ষদে উপস্থাপন করা হতো।

এই প্রক্রিয়ায় পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত ঋণের অর্থ পিকে হালদারের বেনামি বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও তার পছন্দের ব্যক্তির হিসাবে পাঠানো হতো। এ প্রক্রিয়ায় দ্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটির এমডি আবু রাজীব মারুফ ও চেয়ারম্যান কাজী মোমরেজ মাহমুদ গংকে আইএলএফএসএল থেকে ৬০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।

একইভাবে আইএলএফএসএল থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠান কনিকা এন্টারপ্রাইজের মালিক রামপ্রসাদ রায়কে ৬০ কোটি, নিউট্রিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান মিসেস অনামিকা মল্লিক, এমডি মহানন্দ তরুয়া গংকে ৬০ কোটি, ওকায়ামা লিমিটেডের চেয়ারম্যান সুব্রত দাস, এমডি তোফাজ্জল হোসেন ও পরিচালক শুভ্রা রানী ঘোষকে ৮৭ দশমিক ৬০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এসব ঋণ প্রদানের অভ্যন্তরীণ নথিতে আমি, এমডি রাশেদুল হক, এভিপি আল মামুন সোহাগ, সিএফও সৈয়দ আবেদ হাসান সই করি। পরে এসব কাগুজে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে অনুমোদিত ঋণের অর্থ নিজের কোম্পানি ও পছন্দের ব্যক্তিদের হিসাবে সরিয়ে নেন পিকে হালদার। 

ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ভুয়া ঋণের নামে আত্মসাতের অভিযোগে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা হয়েছে। ৩৫০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৩৩ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়। এসব মামলায় পিকে হালদারসহ অন্যদের আসামি করা হয়। ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে এ পর্যন্ত ১১ জন গ্রেফতার হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন পিকে হালদার নিজে। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে এখন বিদেশে অবস্থান করছেন। আইএলএফএসএলের সাবেক এমডি রাশেদুল হকও প্রতিষ্ঠানটির জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম