শ্বাসরুদ্ধকর তিন ঘণ্টার নাটকীয় অভিযান
চিত্রনায়িকা পরীমনি গ্রেফতার
বাসা থেকে বিপুল মাদকদ্রব্য উদ্ধার * গ্রেফতারের আগে ৩১ মিনিটের ফেসবুক লাইভ ঘিরে উত্তেজনা * পরীমনির বিরুদ্ধে দুটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যবসায়ী নাসির

বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রায় তিন ঘণ্টা শ্বাসরুদ্ধকর নাটকীয়তার পর গ্রেফতার হলেন ঢাকাই সিনেমার বহুল আলোচিত নায়িকা পরীমনি। বুধবার রাজধানীর বনানীর বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এদিন তার বাসা থেকে এলএসডি ও আইসসহ বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে তার অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত সদস্যদের সন্ধানে নেমেছে র্যাব।
এদিন বিকালে গ্রেফতার অভিযানের সময় উৎসুক জনতা ও মিডিয়া কর্মীদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দফায় দফায় চেষ্টা করেও র্যাব সদস্যরা যখন বাসায় ঢুকতে ব্যর্থ হচ্ছিল, ঠিক তখন বাসার ভেতর সিনেমার মতোই কাহিনি তৈরি করেন পরীমনি।
র্যাব সদস্যরা দরজা খোলার অনুরোধ করলে তাতে সাড়া না দিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভে এসে কখনো আবেগী, আবার কখনো উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন। অভিযোগ তোলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কে বা কারা তার বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।
মুহূর্তেই সেই লাইভ দেখতে সামাজিক যোগাযোগ মাধমে হুমড়ি খেয়ে পড়েন নেটিজেনরা। লাইভ চলাকালেই তিনি পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।
দাবি করেন, টানা ৩১ মিনিট লাইভে কথা বলার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সম্প্রতি আশুলিয়ার বোট ক্লাব কান্ডে আলোচনার কেন্দ্রে আসেন চিত্রনায়িকা পরীমনি।
সম্প্রতি ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে পরীমনির করা মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও উত্তরা ক্লাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসির ইউ মাহমুদসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের বাসা থেকে গ্রেফতারের সময় মদ ও ইয়াবা উদ্ধার দেখানো হয়।
নাসির ইউ মাহমুদের সঙ্গে গ্রেফতার অন্য চারজন হলেন অমি, লিপি, সুমি ও স্নিগ্ধা। এরা সবাই এখন জামিনে মুক্ত।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই পরীমনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযানকালে তার বাসা থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।
যে কারণে গ্রেফতার : গত ৮ জুন রাতে বোট ক্লাবে হত্যাচেষ্টা ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে পরীমনির করা মামলা তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। তদন্তকালে পুলিশ জানতে পারে পরীমনির করা অভিযোগ মিথ্যা। প্রভাবশালী আরও এক ব্যক্তির সঙ্গে পরীমনির ঘনিষ্ঠতার তথ্যও জানতে পারে পুলিশ।
এমনকি নগ্ন ছবিতে অভিনয়, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আদায়ের তথ্য-উপাত্তও চলে আসে র্যাব গোয়েন্দাদের হাতে।
শুধু পুলিশি তদন্ত নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে মানুষ দেখতে পায় ৮ জুন রাতে বোট ক্লাবের মদের টেবিলে বেশ কয়েক জনের সঙ্গে শান্ত ভঙ্গিতে বসেই মদ পান করছেন পরীমনি।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এই ফুটেজ প্রকাশ হওয়ার পর আড়াল থেকে সত্য বেরিয়ে আসতে থাকে। নাসির ইউ মাহমুদ ও অমিকে উদ্দেশ করে পরীমনির আবেগী সংবাদ সম্মেলনও যে সিনেমার কাহিনির মতো সাজানো ছিল ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ অবস্থায় জামিনে মুক্তি পেয়েই মিথ্যা অপবাদে নিজের সামাজিক মর্যাদাহানির তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে সরকারের উচ্চ মহলে কথা বলেন নাসির ইউ মাহমুদ।
পরীমনির বেপরোয়া চলাফেরার তথ্যপ্রমাণ পেয়েই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। একটি সূত্র জানায়, খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই পরীমনিকে গ্রেফতারের নির্দেশনা আসে।
সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরই বুধবার বিকাল ৪টার কিছু পর সাদা পোশাকে র্যাবের ৩-৪ জন সদস্য পরীমনির বাসায় গিয়ে দরজা খুলতে বলেন। বাইরে অবস্থান নেয় র্যাবের পোশাকধারী সদস্যরা। কিন্তু পরীমনি দরজা না খুলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে থাকেন। উলটো ফেসবুক লাইভে এসে অভিযানে যাওয়া র্যাব সদস্যদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ান।
বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নানা নাটকীয়তার পর পরীমনিকে নিজেদের হেফাজতে নেয় র্যাব। কিন্তু উৎসুক জনতা ও মিডিয়া কর্মীদের চাপ চামলাতে না পেরে তাকে বাইরে বের করে আনতে গিয়ে হিমশিম খায় তারা। এক পর্যায়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর বাসা থেকে বের করে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে সাদা মাইক্রোবাসযোগে র্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ফেসবুক লাইভে যা বলেছেন পরীমনি : র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে তাৎক্ষণিক নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লাইভে আসেন পরীমনি। এ সময় র্যাবের পক্ষ থেকে পরীমনিকে তার বাসায় অভিযানের কথা জানানো হয়। কিন্তু তিনি লাইভে এসে মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার চালানো শুরু করেন।
লাইভে পরীমনি বলেন, আমি ঘুমাইতেছিলাম। বাসার নিচে মেইনগেটে সব ভাঙচুর করে তারা ওপরে চলে আসছে। এখন বাসার গেট ভাঙচুরের চেষ্টা করছে। বারবার কলিংবেল বাজাচ্ছে। পুলিশসহ কেউ শুনছে না, আমি সবাইকে ফোন করলাম, কেউ আসছে না।
মরে গেলে আসবেন ভাই? তিনি আরও বলেন, আমার মনে হচ্ছে এরা ডাকাত। একেক জনের একেক রকমের চেহারা। এরা যদি ডাকাত হয় কী করবেন? আমি এটার ভয় করছিলাম। আমি আজ লাইভ কাটব না।
এখানে থানা থেকে আসতে কতক্ষণ লাগে? মানুষ কি মরে যাবে? তারা নাকি কেউ জানে না, কোন থানা থেকে আসছে, সিআইডি না র্যাব কেউ কিছু বলতে পারছে না।
পরীমনি সবার উদ্দেশে আরও বলেন, আমি বুঝতেছি না আমি মরে গেলে আসবেন? আমি তো হার্ট আট্যাক করব। ব্রেনস্ট্রোক করে মরে যাব। এটা একদম টর্চার। লাইভে থেকে আলোচিত এই চিত্রনায়িকা কারও একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।
তখন তাকে বলতে শোনা যায়, আমি মরে যাব। আর পৃথিবী দেখবে না! আমি লাইভ কাটব না। আমি দেখিয়ে মরব। আমার সঙ্গে কেউ কিছু করে পার পাবে না। আর মেরে ফেললে তো কোনো কিছু করার নেই।
পরীমনির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : বোট ক্লাব কাণ্ডের পরই পরীমনির বেপরোয়া চলাফেরার নানা তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। অলকমিউনিটি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট কে এম আলমগীর ইকবাল সংবাদ সম্মেলন করে পরীমনির বিরুদ্ধে মদ্যপ অবস্থায় তাদের ক্লাবে ভাঙচুরের অভিযোগ তোলেন।
তিনি বলেন, ‘৭ জুন পরীমনি ও তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ওই ক্লাবে গিয়ে গ্লাস ভাঙচুর করেছেন। সেই রাতে ১৫টি গ্লাস ভেঙেছেন, নয়টি স্ট্রে ছুড়ে মেরেছেন এবং অনেকগুলো হাফপ্লেট ছুড়ে ছুড়ে মেরে ভেঙেছেন। ঘটনার দিন পরীমনির সঙ্গে এক ভদ্রলোক ছিল হাফপ্যান্ট পরা আরেকজন মহিলাও ছিল।
এটা রাত প্রায় সোয়া ১টা বা দেড়টার ঘটনা।’
বোট ক্লাবের ঘটনায় নাসির ইউ মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, অমির অতিথি হয়ে সেদিন পরীমনি ও তার সঙ্গে আরও দু’জন ক্লাবে যান। অতিরিক্ত মদ পানের এক পর্যায়ে পরীমনি কয়েকটি গ্লাস ভাঙেন।
তাকে নিবৃত করতে গেলে তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এ অবস্থায়ই তিনি ক্লাবে শোপিস হিসাবে রাখা ৩ লিটারের ব্লু লেভেল ব্রান্ডের একটি মদের বোতল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেটি না দেওয়াতেই পরীমনির ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে পড়েছেন তিনি।
এদিকে পরীমনির বিরুদ্ধে দুটি মামলা করবেন বলে বুধবার যুগান্তরকে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ। মানহানির মামলা করা হবে আদালতে। মামলায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে সম্মানহানি, সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্নের অভিযোগ আনা হবে।
আর বিমানবন্দর থানায় মিথ্যাচারের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগ আনা হবে। আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানোর কথাও বলেন তিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিমানবন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ বিএম ফরমান আলী বুধবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে কারও কোনো অভিযোগ তিনি পাননি।