সমন্বয়হীন টিকা ব্যবস্থাপনা ভোগান্তিতে মানুষ
ভুলত্রুটি পরিমার্জনের এখতিয়ার আমাদের নেই -পরিচালক এমআইএস
রাশেদ রাব্বি
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছয় দিন আগে টিকার জন্য নিবন্ধন করেও এসএমএস পাননি আবুল কালাম নামের এক প্রবাসী শ্রমিক। মাসুদ নামের অপর এক বিদেশগামী জানান, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিএমইটিতে নিবন্ধন হওয়ার কথা। আবেদনের চার দিন পার হলেও তার নিবন্ধন হয়নি। পুলিশ হাসপাতালে নিবন্ধন করেছেন, এসএমএস পেয়েছেন।
কিন্তু পরপর দু’দিন গিয়েও টিকা পাননি এক গণমাধ্যম কর্মী। নিবন্ধন ছাড়া টিকা নেওয়া যাবে না এমন নির্দেশনা রয়েছে। এর পরও নিবন্ধন ছাড়াই গাজীপুরে পোশাক কারখানায় ১২ হাজার শ্রমিককে টিকা দেওয়া হচ্ছে। নিবন্ধনের সময় কোনো ভুল হলে তা সংশোধন করা যাচ্ছে না। ত্রুটি সারানোর বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আইসিটি মন্ত্রণালয় একে অন্যের দিকে ঠেল দিচ্ছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। টিকা গ্রহণের বয়সসীমা ১৮ বছর করা হলেও, এ সংক্রান্ত রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি। সামগ্রিকভাবে করোনার টিকা দেওয়া, নিবন্ধন করা, এসএমএস পাওয়াসহ নানা বিষয়ে সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
আগ্রহীরা বলছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম গণটিকা কার্যক্রম শুরুর সময় একটি শৃঙ্খলা ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি ‘ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট প্লান’ করা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী পরিচালিত হয় টিকা কার্যক্রম। কিন্তু চলতি মাসে দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম শুরু হলেও নানা পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই ধাপে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা পাওয়ায় অগ্রাধিকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও সেখানে রয়েছে জটিলতা। প্রবাসী শ্রমিকরা টিকা পেতে নানা ভোগান্তিতে পড়ছেন। এমনকি সাধারণ মানুষ অনেকে নিবন্ধন করতে পারছেন না, নিবন্ধন করলেও এসএমএস পাচ্ছেন না, এসএমএস পেলেও হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে টিকা শেষ।
এমন পরিস্থিতিতে রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পর্যায়ক্রমে দেশের সবাইকে করোনার টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কোনো মানুষ যেন টিকা থেকে বাদ না যায়, আমরা সেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছি। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের বার্ষিক কর্মসম্পাদনা চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর এবং শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা টিকা দেওয়া শুরু করেছি। টিকা আসছে, দেশের সবাই যেন নিতে পারে, সেজন্য যত দরকার, আমরা কিনব । কোনো মানুষ যেন টিকা থেকে বাদ না থাকে, সেভাবে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।
এদিকে করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়ার অভিযোগ করেছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। নিবন্ধনের চার-পাঁচ দিন পরও এসএমএস পাচ্ছেন না অনেকেই। এর আগে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) নিবন্ধনেও ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম) আয়োজিত এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এসব সমস্যা তুলে ধরেন প্রবাসীরা। বিদেশগামীদের টিকা সহজ করার দাবি জানান তারা।
প্রবাসীদের এসব অভিযোগের ভিত্তিতে টিকা দেওয়ায় আটটি চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো সমাধানে ১১টি সুপারিশ তুলে ধরে বিসিএসএম। লিখিত বক্তব্যে ফোরামের সদস্য তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, সার্ভারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ায় নিবন্ধনে অনেক সময় লাগছে।
বিএমইটিতে নিবন্ধন করা কর্মীদের ফের নিবন্ধন করতে গিয়ে ২০০ টাকা দিতে হচ্ছে। কারিগরি ত্রুটির কারণে কেউ কেউ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একাধিকবার টাকা দিচ্ছেন, তা ফেরত পাওয়ার উপায় নেই। তথ্য জানা না থাকায় হয়রানির মধ্যে পড়ছেন অনেকে। অন্যের সহযোগিতায় নিবন্ধন করতে গিয়ে তথ্যে ভুল হলে তা সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়নি। ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় পার হলেও এসএমএস পাচ্ছেন না। গন্তব্য দেশের অনুমোদিত টিকার বিষয়ে তথ্য পাচ্ছেন না প্রবাসীরা।
সুপারিশে বলা হয়, দাম বেশি হলেও প্রবাসীদের জন্য এক ডোজের টিকা আনা দরকার। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এসএমএস দিতে হবে। প্রচার বাড়ানো দরকার। যাদের স্মার্ট কার্ড আছে, তাদের কাছ থেকে কোনো ফি না নেওয়া। ভুল করে টাকা গেলে তা ফেরতের ব্যবস্থা করা। সার্ভারের সক্ষমতা বাড়ানো এবং নিবন্ধনের প্রক্রিয়া বোঝাতে ব্যাপক প্রচার করতে হবে।
নিবন্ধনসংক্রান্ত ভুলত্রুটি সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এমআইএস) অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান হেলাল যুগান্তরকে বলেন, নিবন্ধিত তালিকা অন্তর্ভুক্তি ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারছি না। টিকা কার্ড সংশোধন, যে কোনো ভুলত্রুটি পরিমার্জন করার এখতিয়ার আমাদের নেই। এই বিষয়গুলো আইসিটি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রাখা হয়েছে।
নিবন্ধন ছাড়াই গাজীপুরে টিকাদান : এদিকে নিবন্ধন ছাড়াই গাজীপুরের চারটি পোশাক তৈরি কারখানার শ্রমিকদের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে রোববার সকালে কোনাবাড়ী থানা এলাকায় তুসুকা ডেনিম লিমিটেড ও তুসুকা ওয়াক্সিং লিমিটেডের চতুর্থতলায় এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় গাজীপুরের সিভিল সার্জন জানান, সেখানে এক সঙ্গে চারটি পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের এনআইডি নিয়ে টিকাদান শুরু হয়েছে। এনআইডি নেওয়ার উদ্দেশ্য হলো প্রয়োজনে পরবর্তীতে নিবন্ধন করা যাবে। গাজীপুরের লক্ষ্মীপুরা চারটি কারখানার ১২ হাজার শ্রমিক প্রাথমিকভাবে এই টিকা পাবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এমএনসিঅ্যান্ডএইচ) ডা. শামসুল হক যুগান্তরকে বলেন, এবার অনেকে একসঙ্গে টিকার নিবন্ধনের চেষ্টা করছে। সক্ষমতার চেয়ে বেশি মানুষ টিকার নিবন্ধন করতে চাওয়ায় কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের টিকা প্রদানের নির্ধারিত সক্ষমতা আছে। নিবন্ধন অনেক বেশি হলেও সক্ষমতা অনুযায়ী টিকা দেওয়া হচ্ছে। তাই অনেকের এসএমএস পেতে দেরি হয়ে থাকে। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের হাতে টিকা আছে, আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম আছে। টিকাদানের পরিমাণ আরও বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। গাজীপুরে নিবন্ধন ছাড়া টিকাদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে একটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে গাজীপুরের চারটি পোশাক কারখানার ১২ হাজার শ্রমিককে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুরুতেই নিবন্ধন করতে না হলেও তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়া হচ্ছে। যাতে পরবর্তীতে তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এই পাইলট সফলভাবে সম্পন্ন হলে পরবর্তীতে এভাবে টিকাদান করা হবে বলেও জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, আজ সন্ধ্যায় দেশে মডার্নার ৩০ লাখ টিকা আসার কথা রয়েছে। শনিবার চীন থেকে দুটি ফ্লাইটে ১০ লাখ ডোজ সিনোফার্মার টিকা এসেছে। এর আগে জুলাই মাসের দুই ও তিন তারিখে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ৪৫ লাখ ডোজ টিকা আসে। এর মধ্যে কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে মডার্নার টিকা এসেছে ২৪ লাখ ৬৭ হাজার ২০০ ডোজ। চীনের সঙ্গে কেনা চুক্তির আওতায় দুই ফ্লাইটে সাইনোফার্মার টিকা এসেছে ২০ লাখ ডোজ। দেশে আগে আসা টিকার মধ্যে ফাইজারের রয়েছে ৯৯ হাজার ৬৭৮ ডোজ এবং সিনোফার্মার রয়েছে ১০ লাখ ছয় হাজার ১৬২ ডোজ। বর্তমানে দেশের সব সিটি করপোরেশনে মডার্নার এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সিনোফার্মার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে দেশে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করা হয়।