‘সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮’
অনুমতি ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না
সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে উপকমিটি * ৩টি ধারা ও ২৫টি উপধারা বাতিলের প্রস্তাব * সচিব কমিটি অনুমোদন দিলে যাবে মন্ত্রিসভায়
বিএম জাহাঙ্গীর
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
টানা দশ বছর ধরে ঘষামাজার পর সরকারি কর্মচারী আইন আবারও আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে। গেল ডিসেম্বরে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি কর্তৃক গঠন করে দেয়া উপকমিটি তাদের সুপারিশ রিপোর্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে।
খসড়া প্রস্তাবনাটি সচিব কমিটির পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করা হবে। এতে মূলত প্রস্তাবিত আইন থেকে ৩টি ধারা এবং অনেকগুলো উপধারা বাদ দিতে বলা হয়েছে। যার সংখ্যা ২৫টি।
সংশ্লিষ্ট একজন পদস্থ কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, মূল আইনে বেশ কিছু ধারায় বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক বেশি বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারা মনে করেন, এতে করে আলোচনা-সমালোচনা করতে গিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ আইনটি চূড়ান্ত হওয়া থেকে পিছিয়ে পড়বে। তাই তারা মনে করেন, আইনে শুধু মৌলিক দিকগুলো বলা থাকবে। এর বাইরে যা কিছু প্রয়োজন সব বিধি দ্বারা সমাধান করা হবে।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইনের নেতৃত্বে গঠিত আহ্বায়ক কমিটি পূর্বানুমতি বতীত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ক্ষমতা সম্পর্কিত বিধানটি আইনের ৪৬ ধারা থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব করেছে।
উল্লেখযোগ্য সংশোধন প্রস্তাবের মধ্যে প্রস্তাবিত আইনটির দ্বাদশ অধ্যায়ে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত কর্মচারীর ক্ষেত্রে ব্যবস্থাদি সংক্রান্ত ৪৬ ধারায় বর্ণিত দুদক আইনের ক্ষমতাবলে কর্মচারীকে গ্রেফতারের আগে অনুমতি নেয়ার বিষয়টি আইন থেকে বাদ দিতে সুপারিশ করা হয়।
আইনটির এ ধারার উপধারা (১)-এ বলা আছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে। তবে শর্ত থাকে যে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ৫ ধারার অধীন গ্রেফতারের ক্ষেত্রে অনুরূপ পূর্বানুমতি গ্রহণের প্রয়োজন হবে না।’
ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত কর্মচারীর ক্ষেত্রে ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৪৭ ধারার উপধারা (১)-এ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে উপকমিটি। এখানে প্রস্তাবিত আইনে বলা আছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক ১ বছরের অধিক মেয়াদের কোনো কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে অনুরূপ দণ্ড আরোপের রায় বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে চাকরি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত হবেন।’ উপকমিটিকে সংশোধন প্রস্তাবে আইন থেকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত’ শব্দটি বাদ দিতে বলা হয়েছে।
ফলে উল্লেখিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন সাপেক্ষে আইনটি চূড়ান্ত হলে সরকারি কর্মচারীরা বড় দুটি সেভগার্ড ভোগ করবেন। এর একটি হল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দুদক গ্রেফতার করতে পারবে না এবং এক বছরের বেশি কারও সাজা হলে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা যাবে না।
এছাড়া উপকমিটি বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের ধারায় ইতিবাচক একটি সংশোধন প্রস্তাব এনেছে। এ ধারার ক্ষমতাবলে চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে কোনো সময় সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারবে।
তবে শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রস্তাব করেছে, ‘কোনোরূপ কারণ না দর্শাইয়া’ শব্দসমূহের পরিবর্তে ‘কারণ দর্শানোপূর্বক’ শব্দসমূহ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। এটি আসলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
সে হিসেবে এই প্রস্তাব যদি সন্নিবেশিত হয় তাহলে সরকারি চাকরিজীবীরা এই কালো আইনের কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবেন। কারণ দর্শানো চিঠির জবাব সরকারের কাছে গৃহীত না হলেও অন্তত এ সুযোগটি তাদের কাছে একটি সান্ত্বনার জায়গা হিসেবে প্রতীয়মান হবে।
উপকমিটি প্রস্তাবিত আইনের ৫৪ ধারায় আরও একটি ইতিবাচক সংশোধন প্রস্তাব তুলে ধরেছে। এ আইনের উপধারা (১)-এ বলা আছে, রাষ্ট্রপতি জনস্বার্থে কোনো কর্মচারীকে চাকরি থেকে অবসর প্রদানের পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারবেন।
উপধারা (২)-এ বলা আছে, তবে শর্ত থাকে যে, অবসরোত্তর ছুটি বহাল থাকলে তিনি যে বেতন-ভাতাপ্রাপ্ত হতেন তা বহাল থাকবে এবং চুক্তির অধীন প্রাপ্য বেতন-ভাতাদির সঙ্গে উহা সমন্বয়যোগ্য হবে না। উপকমিটির প্রস্তাব, ‘চুক্তির অধীন প্রাপ্য বেতন-ভাতাদির সঙ্গে উহা সমন্বয়যোগ্য হবে না’ শব্দগুলো বাদ দেয়া যেতে পারে।
কেউ কর্মস্থলে নিয়মিত উপস্থিত না থাকলে তার বেতন কর্তন বা বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখার কথা বলা হয়েছে আইনটির ৩৪ ধারায়। সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এর সঙ্গে ৩৭ ধারার ক উপধারা অনুসারে লঘুদণ্ড আরোপের শর্তটি যুক্ত করা যেতে পারে।
এছাড়া উপকমিটির প্রস্তাবে আরও বেশ কিছু উপধারা এবং এর অপ্রয়োজনীয় কিছু শব্দ বা শব্দসমূহ বাদ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। অপরদিকে একেবারে ধারা বাদ দেয়ার মধ্যে রয়েছে ১৪, ১৫ ও ১৯ ধারা।
এর মধ্যে ১৪ লিয়েন, ১৫ বৈদেশিক বা বেসরকারি চাকরি গ্রহণ এবং ১৯ ধারায় আত্তীকৃত কর্মচারীর চাকরির শর্তাবলীর বিষয়ে আইনগত দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এত ডিটেল বিষয় আইনে থাকার দরকার নেই। এগুলো বিধি দ্বারা পরিচালিত হলে আরও ভালো হবে। কেননা আইনে সবকিছু বিস্তারিতভাবে পরিষ্কার করা যায় না। কিন্তু বিধিতে খুঁটিনাটি সব যুক্ত করা যায়।
প্রসঙ্গত, সরকারি কর্মচারী আইন এক যুগ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় এ ধরনের একটি আইন প্রণয়নে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু শেষমেশ সেটি না করে নীতিনির্ধারণী বিষয় হওয়ায় তা নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যায়।
অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে এ আইনটির ওপর গুরুত্বারোপ করে। কেননা সংবিধানের বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে গণকর্মচারীদের জন্য আইনটি করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে প্রশাসন সংস্কারের অন্যতম প্রতিশ্র“তি হিসেবে তুলে ধরে।
প্রথমে সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট নামে আইন করার কথা বলা হলেও পরে কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বিশেষে সবার জন্য সরকার কর্মচারী আইন প্রণয়নে ঐকমত্য হয়। শুরু হয় সব পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ।
এতেই পার হয়ে যায় ৫ বছর। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হলে নীতিগত অনুমোদন দিয়ে ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর শুরু হয় নানাভাবে ঘষামাজা পর্ব। সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৫ দিয়ে শুরু হয় এর যাত্রা।
প্রতি বছর সাল পরিবর্তন হলে এখন নামকরণ করা হয়েছে সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দীর্ঘযাত্রায় আইনটি নিয়ে টানাটানি আর পোস্টমর্টেম কম হয়নি। তবে এবার নাকি টানেলের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখা দিয়েছে।
এমনটিই বলছেন সংশ্লিষ্ট কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। প্রস্তাবিত আইনের বিবেচ্য বিলে চাকরি সম্পর্কিত ব্যাপক প্রযোজ্যতাসম্পন্ন ৬টি সরকারি আইন রহিত করার প্রস্তাব করে আইনগুলোর বিধিানসমূহ নতুন এই বিলে কতিপয় ক্ষেত্রে পরিমার্জনপূর্বক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সর্বশেষ আইনের খসড়া নিয়ে গত বছর ৫ ডিসেম্বর প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সচিব কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবকে প্রধান করে অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত এই উপকমিটি গঠন করা হয়।
কমিটি প্রথম সভা করে ১৩ ডিসেম্বর। এরপর আরও ৪টি সভা করে ২ এপ্রিল সংশোধন প্রস্তাব চূড়ান্ত করে। প্রস্তাবটি ২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে, সেখানে অনুমোদন হলে যাবে মন্ত্রিসভায়। মন্ত্রিসভা অনুমোদন করলে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে আইন পাসের জন্য বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।