বিজয়ের ৪৯ বছর
ঢাকা অভিমুখে মুক্তিবাহিনী
কিসিঞ্জারের দুরভিসন্ধি
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিকামী বাঙালি মাতৃভূমি মুক্ত করার তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। একে একে বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করার খবর আসছিল।
বাঙালি বুঝতে পারছিল তাদের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন আর বেশি দূরে নয়। ঠিক এমন সময়ে ভেতর ও বাইরে শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র।
১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর দেশের নানা জনপদ মুক্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এই দিনে যৌথবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছার জন্য চারদিক থেকে অগ্রসর হয়। একটি বাহিনী যায় আশুগঞ্জ, দাউদকান্দি ও চাঁদপুর।
পশ্চিমে আরেকটি বাহিনী পৌঁছে মধুমতি নদীর তীরে। আর অন্য একটি বাহিনী কুষ্টিয়া মুক্ত করে এগিয়ে চলেছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে যায় ময়মনসিংহের কাছাকাছি।
এদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার তাকে পরামর্শ দেন বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরকে যাত্রা শুরুর নির্দেশ দিতে। ইয়াহিয়া খান ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা ভেবেছিল সপ্তম নৌবহর আসার কথা শুনে যৌথ বাহিনীর মনোবল ভেঙে যাবে।
সেই সুযোগে একেবারে শেষলগ্নে চরম আঘাত হেনে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে তছনছ করে দেবে। কিন্তু ঘটনা ঘটে উল্টো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এই কথা জেনে মুক্তিযোদ্ধারা আরও বিপুল উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। সেদিন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আরেক পরীক্ষিত মিত্র তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় এবং এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়।
ফলে সপ্তম নৌবহর যাত্রা শুরুর পরই থেমে যায়। এদিন জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তানি দলের নেতা মাহমুদ আলী দেশে ফিরে এসে দেখা করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে।
পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের উচিত বিশ্ব শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ভারতের পাশ থেকে সরে দাঁড়ানো। চীন ও আমেরিকার সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান তাদের নির্ভীক ও ঐতিহাসিক সমর্থনের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’
এদিন মুক্ত হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি। আর দাউদকান্দি মুক্ত হওয়ার ভেতর দিয়েই শুরু হয় মেঘনা তীরের অঞ্চলগুলো মুক্তির প্রক্রিয়া। দিন না পার হতেই মেঘনার পুরো পূর্বাঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। একই দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ে গাইবান্ধা, গাজীপুরের শ্রীপুর, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নেত্রকোনায়।
এদিকে মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা এখন বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন-পাকিস্তানিরা যদি মাটি কামড়ে ঢাকায় লড়াই চালাতে চায় আপনি কী করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দেন, ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।
সাংবাদিকরা আবারও প্রশ্ন করেন-ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী? অরোরা জানালেন-নদী যদিও বড় বাধা; কিন্তু সে বাধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য ও রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আর আমাদের পিটি-৬৭ জলচর ট্যাঙ্কগুলো নদী পেরিয়ে যেতে পারবে। মিত্রবাহিনী দ্রুত ঢাকা পৌঁছার লক্ষ্য নিয়ে চারদিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে।
এইদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর উপদেষ্টা পরিষদের এটিই ছিল প্রথম বৈঠক। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বিকালে ভারতীয় বিমানবাহিনী জামালপুরে হানাদার ঘাঁটির ওপর এক ঘণ্টা ধরে কয়েক হাজার পাউন্ডের বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে পাকসেনারা পালাতে শুরু করে। জামালপুর থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় যৌথ বাহিনীর কাছে ৬শ’ পাকসেনা ধরা পড়ে।