অস্ত্র মামলায় সাহেদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
আরেকটি ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড, দুই সাজা একসঙ্গে কার্যকর
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে (সাহেদ করিম) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সোমবার ঢাকা মহানগরের এক নম্বর স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ এ রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে অস্ত্র আইনের ১৯(এ) ধারায় সাহেদকে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আরেকটি ধারায় সাহেদকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। দুই ধারার সাজা একসঙ্গে কার্যকর হবে।
এছাড়া রায়ে সাহেদকে ‘ধুরন্ধর ও ভদ্রবেশী অপরাধী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে আদালত বলেছেন, আমাদের সমাজে সাহেদের মতো ভদ্রবেশী অপরাধী লোকদের জন্য এ রায়টি একটি বার্তা হিসেবে থাকবে।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে এদিন সাহেদকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কারাগার থেকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে আনা হয়। রায় ঘোষণার জন্য আদালত বসার আগে তাকে আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়।
কারাগার থেকে আদালতে আনার সময় সাহেদের হাতে হাতকড়া, শরীরে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও মাথায় হেলমেট দেখা যায়। দুপুর ১টা ৫৬ মিনিটে সাহেদকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে আদালতে তোলা হয়।
এরপরই আদালত রায় পাঠ শুরু করেন। দুপুর ২টা ৯ মিনিটে সংক্ষিপ্ত রায় পাঠ শেষ করেন বিচারক।
এদিকে রায়ে রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি মো. আবদুল্লাহ আবু ও অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
রায় ঘোষণার পর আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, সাহেদের চতুরতা দেখে আদালত অবাক হয়েছেন। এ রায় সাহেদের মতো ভদ্রবেশী অপরাধীদের জন্য বার্তা দেয় যে- অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না।
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান বলেছেন, তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।
রায় ঘোষণার পর পরই সাহেদকে কারাগারে নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। প্রিজনভ্যানের ভেতর থেকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সাহেদ বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার পাইনি। আমি রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করব। আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।’
রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ : আদালতের কাছে চতুরতার সঙ্গে তথ্য গোপন করায় রায়ে বিচারক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আদালত বলেছেন, উত্তরা পশ্চিম থানার এক মামলায় রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সাহেদ পুলিশকে জানায়, উত্তরায় তার একটি গাড়ি আছে এবং সেখানে একটি অস্ত্র আছে।
এরপর আসামিকে সেখানে নিয়ে গেলে ড্রাইভিং সিটের পেছন থেকে সে একটি অস্ত্র বের করে দেয়। যে গাড়িটি থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে- সাহেদ পরবর্তী সময়ে আদালতের কাছে দাবি করেছেন, সেই গাড়িটি তার নয়।
কিন্তু গাড়িটি পূবালী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নিয়ে কেনা হয়েছে। যখন ব্যাংক কর্মকর্তা আদালতে এসে সাক্ষী দিয়েছেন, তখন গাড়িটি যে তার (সাহেদের), এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে।
এই আসামি এতটাই ধুরন্ধর যে, তার গাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার হওয়া সত্ত্বেও গাড়িটি যে তার- এ বিষয়টি চতুরতার সঙ্গে আদালতের কাছে লুকিয়ে গেছেন। ফলে আসামি আদালতের কাছে কোনো প্রকার অনুকম্পা পেতে পারেন না।
আমাদের সমাজে সাহেদের মতো ভদ্রবেশী অপরাধী লোকদের জন্য এ রায়টি একটি বার্তা হিসেবে থাকবে।
সাহেদের অস্ত্র মামলা ও বিচার : ১৬ জুলাই করোনা টেস্ট জালিয়াতির মামলায় সাহেদের ১০ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে সাহেদ জানায়, উত্তরায় তার একটি গাড়ি আছে।
গাড়িতে একটি অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এরপর সাহেদকে নিয়ে ওই অবৈধ অস্ত্রটি উদ্ধার করা হয়। তদন্ত শেষে ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশ এ মামলায় সাহেদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়।
২৭ আগস্ট আদালত এ চার্জশিট গ্রহণ করে সাহেদের বিরুদ্ধে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন। ১০ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৫ সেপ্টেম্বর।
মামলায় মোট ১৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। ১৬ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন সাহেদ।
১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সাহেদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দাবি করা হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আদালত রায় ঘোষণার জন্য এ দিন ধার্য করেন।
অর্ধশতাধিক মামলার আসামি সাহেদ : ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম।
অভিযানে ভুয়া করোনা টেস্টের রিপোর্ট, করোনা চিকিৎসার নামে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম উঠে আসে। এরপর রিজেন্ট হাসপাতালের দুটি শাখাকেই সিলগালা করা হয়।
৭ জুলাই রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় করোনা টেস্ট প্রতারণার অভিযোগে মামলা করে র্যাব। মামলায় সাহেদসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় ১৫ জুলাই সাতক্ষীরা সীমান্ত এলাকা থেকে সাহেদকে গ্রেফতার করা হয়।
পরদিন এ মামলায় তার ১০ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। এরপর আদালতের অনুমতিক্রমে ডিবি পুলিশ সাহেদকে নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করে।
অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের ঘটনায়ও পৃথক দুটি মামলা হয় সাহেদের বিরুদ্ধে। এছাড়া অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাহেদের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব মামলা ছাড়াও সাহেদের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশে প্রতারণা, অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে।
এসব মামলায় একাধিক দফায় রিমান্ডও খেটেছেন সাহেদ। দুদকের দুটি মামলাসহ এখনও অনেক মামলায় সাহেদকে রিমান্ডে নেয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, অস্ত্র আইনের এ মামলাটি নিয়ে সাহেদের বিরুদ্ধে মোট দুটি মামলার রায় হল। এর আগে ২০১০ সালে চেক জালিয়াতির মামলায় ঢাকার একটি আদালত সাহেদকে ছয় মাসের সাজা দেন।